কয়েক দিন আগেও ছিল ধানের খেত। মানুষের যাতায়াতের পথ ছিল। এখন সবই আজ জলের তলায়।
জলমগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায় নৌকায় ঘুরে দেখা গেল, কোনও বাড়িতে জল মানুষ-ডোবা, কোথাও বা হাঁটু সমান জল। যাঁদের উপায় ছিল বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আর যাঁদের উপায় নেই, খাটের উপর খাট লাগিয়ে বা ঘরের মধ্যেই বাঁশ কেটে মাচা তৈরি করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জমা জলের সঙ্গে। তবে বৃষ্টি না-থামলে তাঁদের সেই লড়াই কতক্ষণ টিকবে, তা বলা মুশকিল। দিন কয়েক ধরে টানা বৃষ্টির ফলে ইছামতীর নদী জল পাড় উপচে ও খাল দিয়ে ঢুকে পড়ায় গাইঘাটার খেজুরভিটা গ্রামের বর্তমান অবস্থা এখন এমনই। স্থানীয় রামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কয়েক হাজার বিঘে এলাকা নিয়ে রয়েছে চাতুর বিল। এই বিলটিই এখন বিলচাতুরিয়া খেজুরভিটে এলাকার মানুষের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুজোর আগে থেকেই শুরু হওয়া বৃষ্টি এখানকার মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে শারদীয়ার আনন্দ। জলবন্দি মানুষের কাছে ঠাকুর দেখতে যাওয়াটা ছিল বিলাসিতা। এই অবস্থায় কোজাগরীতে লক্ষ্মীর আবাহন কী ভাবে হবে তা নিয়ে চিন্তায় এই অঞ্চলের মানুষ। |
খেজুরভিটার ৪৬টি পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় একটি স্কুলে। বেশির ভাগই দিনমজুর পরিবার। কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গ্রামের ইটের রাস্তার ধারে বাড়ি অবিনাশ মণ্ডলের। ঘরে ও বাড়ির উঠোনে জল। পরিবারের সদস্যরা পাটকাঠি দিয়ে রাস্তার সঙ্গে ঘরে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করেছেন। তবে, দু-চার দিন বৃষ্টি হলে গোটা রাস্তাটাই জলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। অবিনাশবাবু বললেন, ‘‘জলের জন্য কাজকর্ম সব বন্ধ। কী ভাবে পেট চলবে জানি না।’’ জবা বাইন বলেন, ‘‘আমরা যারা ঘর ছেড়ে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছি, তারা ত্রিপল পেলেও চাল-আটা কিছুই পাইনি। কী খাব জানি না।’’
গ্রামবাসীরা জানালেন, ইছামতীর নাব্যতা কম যাওয়ার জন্য পড়া উপচে জল ঢুকেছে বিলে। অতীতে বিলে পাট-তিল চাষ হত। বহু বছর ধরে তা বন্ধ। শুধু ইছামতী নদীর জলই যে বিলে ঢুকেছে তা নয়, ১৭টি খাল-বিলের জলও এখন চাতুর বিলে আসে। জল নামতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়।
বুধবার বিকেলে গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুব্রত সরকার ও সহ-সভাপতি ধ্যানেশনারায়ণ গুহ নৌকা করে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এলাকার মানুষ তাঁদের কাছে দাবি করেন, স্থানীয় বেড়িগোপালপুরে যে স্লুইস গেট আছে, তা ভেঙে দিতে হবে। তাহলে এই দুর্ভোগে পড়তে হবে না। ইছামতী নদী দিয়ে এই বিলে নোনা জল ঢুকে পড়ার জন্য চাষের কাজও এখন তেমন হয় না। উল্টে বর্ষায় নদীর জল বিলে ঢুকে সংলগ্ন এলাকার মানুষকে ভাসিয়ে দেয়। চাতুরবিলের জল নারায়ণপুর খাল হয়ে বেড়ির বাঁওর দিয়ে স্লুইস গেট দিয়ে ইছামতীতে বেরিয়ে যেত। কিন্তু এখন নারায়ণপুর খাল মজে যাওয়ায় এবং স্লুইস গেটের কাছে পলি জমে যাওয়ায় জল বের হয় না। নরায়ণপুর খালের দু’ধারের বহু পরিবারও জলবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ধ্যানেশবাবু বলেন, ‘জল শুকিয়ে গেলে খাল-বাঁওর সংস্কার করে কী ভাবে মানুষদের এই দুর্ভোগের হাত থেকে বাঁচানো যায় তার পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ করা হবে।’ শুধু এই এলাকাই নয়, গাইঘাটার বলদেঘাটা খাল সংস্কার না-হওয়ার ফলে বহু পরিবার জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। এখানে সড়কের উপর দিয়েও জল বইছে। আগে যমুনা-ইছামতী হয়ে জল বেরিয়ে যেত। কিন্তু সবই মজে যাওয়ায় জল আর বেরোতে পারে না। স্থানীয় মাণিকহিরা এলাকাতেও একই ছবি।
গাইঘাটার বিডিও পার্থ মণ্ডল বলেন, ‘‘গাইঘাটা ব্লকে ৫ হাজার মানুষ জলবন্দি। ১০০ ত্রিপল ও ১০ কুইন্টাল চাল দেওয়া হয়েছে।’’ শুধু স্কুলে নয়, উঁচু জায়গায় অনেকে ত্রিপল টাঙিয়ে রয়েছেন। বাসিন্দাদের বক্তব্য, যমুনা ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ছাড়া সমস্যা পুরোপুরি মিটবে না। বিক্ষিপ্ত ভাবে যমুনা ও ইছামতী থেকে পলি তুলে সংস্কার করা হলেও নোনা জলের সঙ্গে ফের পলি ঢুকে নাব্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে, গাইঘাটা ব্লকের মানুষ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। খাল-বাওড় সংস্কার নিয়ে ধ্যানেশবাবু বলেন, “শীঘ্রই পরিকল্পনা তৈরি করে সেচ দফতরের কাছ পাঠানো হবে।’’ তবে, এই দুর্ভোগ এখানকার মানুষের নিজেদের ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছেন। জলবন্দি এক বৃদ্ধের কথায়, ‘প্রতি বছর বাবুরা আসেন। নদী-বাওড়ের পলি তোলার প্রতিশ্রুতি আর চাল-ত্রিপল দিয়ে চলে যান। কিন্তু দুর্ভোগ ফিরে আসে।’’ |