এ বারের ত্যাগের ঈদে চরবাসীরা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কী করে কুরবানির পশু উৎসর্গ করবেন?
উৎসবই বা কী করে পালন করবেন? মাস খানেকের বানের জলে মাঠের ফসল আর ঘরে মজুত রাখা খাদ্যশস্য পচে নষ্ট। বানের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে বাড়ি। সম্বল বলতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ঘরের ভাঙাচোরা কাঠামোর উপর সরকারি ত্রাণের ত্রিপল।
দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই ঈদ-উল-আযহা, বাঙালির জোড়া উৎসবের রথ যেন থমকে দাঁড়িয়েছে ভগবানগোলা, রানিতলা, রানিনগর ও ইসলামপুর মিলিয়ে লাগোয়া ৪টি থানা এলাকার জল ও ডাঙা নিয়ে প্রায় ১৬০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত চরের বানভাসি বসতিতে এসে। বাংলাদেশের সীমানায় পদ্মার দু’টি শাখা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় গড়ে উঠা নির্মল চর ও চরকুঠিবাড়ির মতো প্রত্যন্ত এলাকাগুলি উৎসবের আনন্দের বদলে চিন্তিত শিশুর খাদ্য, রুগীর পথ্য ও মাথার উপরের আচ্ছাদন নিয়ে।
পদ্মার স্রোতের মতো দেবী এখানে চঞ্চলা। দু’চার বছরের বেশি এক ভিটেয় অবস্থান করেন না। কারণ ফি বছরের নদীভাঙনে ভিটেটুকুও থাকে না। অস্থির মতি জগজ্জননীকে নিয়ে তাই চরের বাসিন্দাদের বেশ মুশকিল। তবু মা চণ্ডীকে তুষ্ট করতে বরাবরের মতো এ বছরও পুজোর আয়োজন হয়েছিল। কারণ, বিশ্বাস মা চণ্ডীর ইচ্ছাতেই নাকি কীর্তিনাশা পদ্মার বানে ও ভাঙনে মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব-সর্বহারা হয়। ফের পদ্মার উর্বর পলি বিধৌত চরা পড়ে, নতুন চর গড়ে ওঠে, তৈরি হয় নতুন চরের বসতি। তাই এ বারও মা চণ্ডীকে তুষ্ট করতে পুজোর আয়োজন হয়েছিল। |
কেমন সেই আয়োজন? ভগবানগোলা ২ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কংগ্রেসের ঊর্মিলা মণ্ডল নির্বাচিত হয়েছেন নির্মলচর এলাকা থেকে। বাড়ি চর মহিষমারি এলাকায়। তাঁর স্বামী কমল মণ্ডল বলেন, “কোনও মতে দেবীর আরাধনা হয়েছে। বানের জলে এ বার সবই গিয়েছে। ভেঙে যাওয়া বাড়িটুকু এখনও খাড়া করতে পারেনি চরের মানুষ। তাই জাঁকজমক করে পুজো করার ভাবনাটাই আকাশ-কুসুম কল্পনা।” যে টুকু আয়োজন ছিল সে টুকুও পণ্ড করে দেয় অষ্টমী থেকে একাদশী পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টি।
গ্রীষ্মে ওই ভূখণ্ডের আদিগন্ত কেবল ধূ ধূ বালির বিস্তার। বর্ষায় কেবল জল আর জল। ওই দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপের মতো অগোছালো, বিধ্বস্ত জনবসতি। বন্যাপ্লাবিত নির্মলচর তখন দ্বীপ। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে তখন জেগে থাকে গাঙচিল, সাপখোপ, মাছরাঙা, ইলিশ, ট্যাংরার সঙ্গে সাঁতার জলে ডুবে যাওয়া কুঁড়েঘরের চালা। ওই চালায় হাঁস, মুরগি, কুকুরছানার সঙ্গে নিজের দুধের শিশুটি বুকে আগলে দুর্গার প্রতিমা কাঠের কাঠামো আঁকড়ে নিয়ে দিন জাগেন, রাত জাগেন ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এর গৃহিনী আর গৃহস্থ।
সত্যিই কি তাঁরা ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এর বাসিন্দা? নির্মলচরের বাসিন্দা ফরওয়ার্ড ব্লকের সারথি মণ্ডল স্থানীয় আখরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন উপপ্রধান। সারথিদেবী বলেন, “সরকারি খাতা কলমে নির্মলচরের একটা ঠিকানা রয়েছে বটে। তবে বাস্তবে আমরা কোন দেশের তা আজও ঠাওর করতে পারলাম না।” সরকারি ওই ঠিকানাটিও কয়েক বছর আগে নদী ভাঙনে পদ্মার অতল জলে হারিয়ে গিয়েছিল। আখরিগঞ্জ লাগোয়া চরকুঠিবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতটির পুরোটাই পদ্মাগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। ফলে সরকারি পরিসংখ্যানেই মুর্শিদাবাদ জেলার ২৫৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত এখন ২৫৪ তে এসে ঠেকেছে। আদিগন্ত জলের বুকে জেগে থাকা ওই চরের মতো কাশফুল আর কোথায় রয়েছে? সেখানে পদ্মার জলে দুলছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত কাশবন, নীল আকাশের নীচে মাঠে মাঠে কাশ ফুল। দেবী আরাধনার প্রাকৃতিক ওই উপাচার নিয়ে শরৎ এখানে হাজির। নির্মলচরের মাঝচর-মহিষমারি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন আখরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সিপিএমের আলউদ্দিন শেখ। তিনি বলেন, “মাসখানেক আগে বানের জল সরেছে। নির্মলচরের দু’টি ঈদগাহের মাটি সবে শুকিয়েছিল। কিন্তু অষ্টমীতে শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। থামল একাদশীতে। দ্বাদশীতে ঈদের নমাজ পড়তে হল ভিজে যাওয়া থকথকে কাদামাটিতে।” ওই এলাকার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের উকিল হাসান বলেন, “ঘরের খাবার, মাঠের ফসল, মায় ঘর পর্যন্ত সব খেয়েছে এ বারের ভয়াবহ বন্যা। ফলে এ বার নিঃস্ব নির্মলচরে ঈদ আছে কিন্তু কুরবানি নেই!” |