থিম আছে। টাকা আছে। শিল্পবোধ আছে। এমনকী, প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারও আছে। জাঁকজমকের এই আবহে একটি দিক তবু উপেক্ষিত।
পরিবেশ-সচেতনতার বিষয়ে কিন্তু কলকাতার পুজো এখনও অনেকটা পিছিয়ে বলে মেনে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ থেকে প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের অনেকেই। ২০১৩-র শারদোৎসবেও এ ছবি পাল্টাতে সরকারের ছিটেফোঁটা হেলদোলও চোখে পড়ল না।
মণ্ডপের সাজ থেকে শুরু করে প্রতিমার রং, মণ্ডপে মাইকের ব্যবহার থেকে বিদ্যুতের অপচয় পরিবেশবন্ধু পুজো বলতে এই দিকগুলিতেই জোর দেন বিশেষজ্ঞেরা। শহরের ফুসফুস বিভিন্ন পার্ক ও মাঠের পরিবেশ নষ্ট না-করে পুজোর আয়োজন থেকে শব্দের তাণ্ডবমুক্ত বিসর্জনও এই মাপকাঠিতে পড়ে। এ সব ত্রুটি শুধরে পুজোগুলিকে পরিবেশ-বিধি মানতে বাধ্য করা এখনও দূর অস্ৎ। এমনিতে পুজোর নিরাপত্তার দিক বিচার করে পুলিশ, পুরসভা ও দমকল তাদের ছাড়পত্র দেয়। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, পরিবেশ দফতরও কি পারে না পুজোর জন্য নির্দিষ্ট পরিবেশ-বিধি বাঁধতে? সে নিয়ম মেনে না-চললে যাতে বাতিল হয় সে সব পুজোর অনুমোদন।
নির্দিষ্ট কয়েকটি পুরস্কার জেতার স্বার্থে কয়েকটি পুজো অবশ্য থিমে নাম-কা-ওয়াস্তে পরিবেশবন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে পরিবেশের তোয়াক্কা করেন না অনেকেই। কোনও কোনও পুজোকর্তা অবশ্য এই যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, একালে থিমপুজোর প্রতিযোগিতার দৌলতে বরং পরিবেশ নষ্ট করার বিষয়ে অনেকে সজাগ হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার এক পুজোকর্তা বলছিলেন, “প্রতিমার দূষণমুক্ত রং নিয়ে কুমোরটুলির শিল্পীদের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধান বার করা হয়েছে।” সেকেলে সিসা বা ক্যাডমিয়ামযুক্ত রং ভাসানের সময়ে গঙ্গায় মিশলে দূষণে মানুষের বড় মাপের ক্ষতি হতে পারে। চর্মরোগ থেকে ক্যানসার, অনেক ধরনের অসুখই ছড়াতে পারে। তবু এ বিষয়ে বারংবার সচেতন করেও কয়েক জন পুজো উদ্যোক্তাকে পথে আনা যায়নি। আবার কারও কারও মনোভাব স্রেফ সিসামুক্ত রঙের প্রতিমা তৈরি হলেই পরিবেশরক্ষায় ‘যথেষ্ট’ করা হল।
একই রকম অনড় মনোভাব কয়েকটি পুজোর জন্য মাসের পর মাস রাস্তা আটকানো বা পার্ক দখলের মানসিকতায়। অঞ্জলির মন্ত্র থেকে লাগাতার ঘোষণা, গভীর রাতেও গান শব্দাসুরের অত্যাচারও কম নয়। হাতিবাগান বা নিউ আলিপুর যেখানেই থাকুন, উৎসবের রোশনাইয়ের আড়ালে এটাও দিনলিপি শহরের পুজোর। পুজোকর্তারা অবশ্য দাবি করবেন, লোকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই এই ভোগান্তি মেনে নেয়।
শহরের আমনাগরিকের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলে। দমদম পার্কের বাসিন্দা, সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তা যেমন বলছিলেন, “জানলা খুলতেই তারস্বরে মাইক।”
বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, পুজোর ক’দিন আলো ঝলমলে শহরে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় পক্ষীকুলেরও। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছিলেন, “গাছে-গাছে যা আলোর সাজ, তাতে পাখিদের সুস্থ থাকার কি জো আছে। যারা পরিবেশ-সচেতনতার গালভরা থিম করে হিমবাহ গলে যাওয়া বা সমুদ্র-দূষণ নিয়ে জ্ঞান দেয়, তাদেরই পাখিদের প্রতি মায়া-দয়া নেই।”
পুজোর উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ নষ্ট করার অভিযোগও উঠে আসছে। রাজ্যের অপ্রচলিত শক্তি উন্নয়ন নিগমের প্রাক্তন কর্তা শান্তিপদ গণচৌধুরীর আক্ষেপ, পুজোর জন্য চার দিনে ঘণ্টায় ৩০০ টন কয়লা পুড়িয়ে বাড়তি ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। অথচ, একটু বাজেট বাড়বে বলে সৌর আলোয় বেশির ভাগ পুজো কমিটিরই উৎসাহ নেই।” গত বছর কালিকাপুরে সৌর আলোর মণ্ডপ তৈরি করেছিলেন শান্তিবাবু নিজেই। এ বার বেহালা, আমহার্স্ট স্ট্রিটের কয়েকটি পুজোয় আংশিক ভাবে সৌর আলোর কাজ হয়েছে। শান্তিবাবুর মত, বিসর্জন বিকেলের দিকে বেঁধে দিলেও জেনারেটরের ডিজেল পুড়িয়ে শোভাযাত্রার দূষণ অনেক কমে।
থিমের নাম করে মণ্ডপের সাজে গাছের ডাল ব্যবহারের প্রবণতারও কট্টর সমালোচক সুভাষবাবু। তাঁর বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টও একটি সাম্প্রতিক রায়ে বলেছে, জঙ্গলের গাছপালা শহরে এনে এই ধরনের প্রদর্শন করা যাবে না। কারা শুনছে এ সব কথা?” তাঁর আপত্তি লাউয়ের খোল বা কলাগাছের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ পুজোর সাজে ব্যবহার করা নিয়ে। “এ সব করতে গিয়ে অনেক সময়েই খাবার নষ্ট হয়। ছোবড়া দিয়ে সার-জ্বালানি হোক, মণ্ডপ সাজানোর কী মানে!” বলছেন সুভাষবাবু। বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণ কিন্তু পুজোর জন্য গাছ কাটা নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই বলেই বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এ রাজ্যের পুজো-উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখন রয়েছেন শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী। তাঁদেরই অন্যতম অরূপ বিশ্বাস অবশ্য থিমপুজোর বিরুদ্ধে অভিযোগ গায়ে মাখতে নারাজ। তাঁর দাবি, “পুজোয় পরিবেশ-রক্ষার দিকটা আমরা সব সময়ে মাথায় রাখি। আমার পুজোয় থিমের দরকারে গাছপালা ব্যবহার করলেও গাছের ক্ষতি যাতে না-হয়, সে নিয়ে আমরা সজাগ।” তবে অন্য কয়েকটি পুজোয় সমস্যা যে থাকতে পারে, তা উড়িয়ে দিতে পারছেন না অরূপবাবুও।
পুজোর আয়োজনে এই সব ত্রুটি বহাল থাকে ভাসান-পর্বেও। কলকাতার কয়েকটি ঘাটে পুরসভা তৎপর হয়েছে। সেখানে পুজোর ফুল-টুল ইদানীং গঙ্গায় ফেলা হয় না। কিন্তু মুম্বইয়ের গণেশপুজোর ভাসান পরিবেশ-সচেতনতায় কলকাতাকে দশ গোল দেবে। এ বারই দেখা গিয়েছে, মুম্বইয়ের পাওয়াইয়ে প্রতিমা এক বার ক্রেনে করে চুবিয়েই তুলে নেওয়া হচ্ছে। পুর-কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করছেন প্রতিমার সদ্গতির। ইলাহাবাদ হাইকোর্টও যমুনায় বিসর্জন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু কলকাতা আছে কলকাতাতেই। বিসর্জনের পরে ঠাকুরের কাঠামো তুলে নেওয়া হলেও দূষণ-বিষের থেকে কিন্তু রেহাই নেই। পুজোর এই সমস্যাগুলো নিয়ে কতদিন চোখ বুজে থাকবে প্রশাসন? পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের কাছে সদুত্তর মেলেনি। তাঁর কথায়, “আমরা পরিবেশ-নীতি কী হবে, ঠিক করি। পরিবেশ-সচেতনতার প্রচার করি। কে কী মানল বা মানল না, সেই নজরদারির সুযোগ আমাদের নেই।” |