যখন বাবা বলেছিল, “তুই এখন স্কুল যাবি না”, তখন মনে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। এখন বাবা বলছে, “তোর ঠাকুর দেখা হবে না!”
বছর নয়েকের ছেলেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, কেন তাকে দুগ্গাঠাকুর দেখতে যেতে দেওয়া হবে না! কেন এক দিনের জন্যও ডাক্তারকাকুরা তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়বেন না! বন্ধুরা কত ঠাকুর দেখবে, ড্রাগন-দোলনা চাপবে, ক্যাপ ফাটাবে, ফুচকা খাবে... আর তাকে এই হাসপাতালের ঘরে বসে ফিনাইল আর ওষুধের গন্ধ শুঁকতে হবে। সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী, সেই ইঞ্জেকশন-স্যালাইন-ব্যথা-বিচ্ছিরি তেতো ওষুধ!
অভিমানে বাবার কিনে দেওয়া নতুন জামায় হাত ছোঁয়ায়নি হাওড়া উদয়নারায়ণপুর ইনস্টিটিউশনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রঞ্জিত হম্বির। কিচ্ছু ভাল লাগছে না ওর। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রক্তের ক্যানসার ধরা পড়েছে। তখন থেকেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিশু ক্যানসার বিভাগই তার ঘরবাড়ি। ক্যানসার ব্যাপারটা কী, সে বুঝতে পারে না। কিন্তু জানে, এর জন্যই তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। এ বার দুর্গাপুজো দেখাও বন্ধ।
ছেলের সঙ্গে বাবা-মাও যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কোনও রকম চোখের জল সামলে রঞ্জিতের মা অলকা হম্বির বলেন, “হাওড়ার বেলগাঁও গ্রামে বাড়ি। জীবনে কখনও কলকাতার পুজো দেখিনি। ভাগ্য দেখুন, এ বার পুজোয় কলকাতায়। হাসপাতাল থেকে বেরোলেই ডাইনে-বাঁয়ে বড় বড় পুজো, আলোর রোশনাই, জনস্রোত। তবু ছেলেটাকে একটাও ঠাকুর দেখাতে পারছি না, ভালমন্দ খাওয়াতে পারছি না।”
রঞ্জিতের সঙ্গেই ওয়ার্ডের শয্যায় আরও কত বাচ্চা! কেউ আরও ছোট, কেউ একটু বড়। কারও হাতে স্যালাইনের নল, কারও সংক্রমণ এড়াতে মুখে সবুজ রঙের কাপড়ের মাস্ক। কারও ১১টা কেমো হয়ে গিয়েছে, কারও ১৮টা। এই বয়সের হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচি করার মতো শারীরিক জোরটুকুও ওদের নেই। ওয়ার্ডে একটু হেঁটেচলেই
বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়। তার পর ধুঁকতে থাকে। |
আড়াই বছরের বিবেক যেটুকু কথা বলতে শিখেছিল, হাসপাতালে থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে দুগ্গাঠাকুরের নাম শুনে একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে দেখায়, মোবাইলে ঢাকের আওয়াজ শুনে দিব্যি কোমরও দোলায়। বিবেকের রক্তের ক্যানসার ধরা পড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। আসানসোল থেকে মা রিনাদেবী এসে মেডিক্যালে ভর্তি করেন ছেলেকে। স্বামী মারা গিয়েছেন গত বছর। তার পরে ছেলের এই মারণরোগ। একের-পর-এক ধাক্কা খেয়ে বছর তিরিশের যুবতী-মা কেমন যেন পাথরের মতো। জানালেন, আসানসোলে তাঁর শ্বশুরবাড়ির দুর্গামন্দির রয়েছে। খুব ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকারই হয় না। এ বার জীবনের সবটাই অন্ধকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোক সম্পর্ক রাখেন না। পুজোতে ছেলেটাকে একটা জামাও পাঠাননি কেউ।
ওদের কি ঠাকুর দেখার জন্য এক বারও ছাড়া যায় না? হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান স্বপ্না চক্রবর্তীর জবাব, “কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত। এখন বাইরে এত দূষণ, ভিড় যে কোনও সময়ে সংক্রমণ হয়ে যেতে পারে। তাই ছাড়া হয় না।” পুজোর চার দিন কোনও আলাদা ব্যবস্থা? স্বপ্নাদেবী বলেন, “পুজোয় কিছু হয় না। পয়লা জানুয়ারি ফাংশন হয়।”
বুধবার বিকেলে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, বিবেকের পাশের শয্যায় দেওয়ালের দিকে মুখ করে কুঁকড়ে শুয়ে একটানা কেঁদেই চলেছে ছয় বছরের শিল্পা। দুটো নতুন পুতুল, একটা ভুতের গল্পের বই কিনে দিয়েও মা শুক্লা মণ্ডল তাকে ভোলাতে পারছেন না। মঙ্গলবার এই ওয়ার্ড থেকেই দু’টি বাচ্চার ছুটি হয়েছে। তারা পুজোয় বাড়ি গিয়েছে। সেই থেকেই বর্ধমান আমবাগান এলাকার সুভাষ বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী শিল্পাও বাড়ি যাওয়ার জেদ ধরেছে। দুর্গাপুজোয় কিছুতেই সে হাসপাতালে থাকবে না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে জানিয়েছে, তাকে কমলা রঙের আইসক্রিম খেতে দিতে হবে, টয়ট্রেনে চাপতে দিতে হবে। লাল রঙের হেয়ারব্যান্ড আর নেলপালিশ পরে ঠাকুর দেখতে যাবে সে।
সাড়ে তিন বছরের বাসু হরিজনও আনমনা। তার বিছানায় নিতান্ত অবহেলায় পড়ে রয়েছে নীল-কালো-লাল রঙের নতুন খেলনাগাড়ি। বাসু মাঝে-মাঝেই ঘর থেকে হেঁটে বেরিয়ে গিয়ে নীচে যাওয়ার জন্য মার হাত ধরে টানছে। মা অসহায়। ডাক্তারের নির্দেশ, তাই পরের বছরের পুজো দেখানোর আশায় ছেলেকে জোর করে বিছানায় টেনে এনে হাতে স্যালাইনের নলটা লাগিয়ে দেন শঙ্করীদেবী। ছোট্ট ছেলের কান্নাতে তখন ম্লান হয়ে যায় জানলা দিয়ে দেখতে পাওয়া সাজানো আলোর মালা। |