ঘুম ভাঙিয়ে খবরটা দিল মেয়ে। “কিন্তু তখন তো মাঝরাত। নোবেল-টোবেল কিচ্ছু নেই মাথায়।”
বলছিলেন অ্যালিস মানরো। ২০১৩-র সাহিত্যের নোবেল-জয়ী। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার এক ঘণ্টা আগে সাধারণত পুরস্কারপ্রাপকদের ফোন করে জানানো হয়, কিন্তু মানরোর সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেনি সুইডিশ অ্যাকাডেমি।
কানাডীয় লেখিকা অ্যালিস মানরোর নাম বেশ কয়েক বছর ধরেই সম্ভাব্য নোবেল-প্রাপক হিসেবে উঠে আসছিল। অনেকেই বলছিলেন, এ বছর পদক যাবে জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির ঝুলিতে। কিন্তু বৃহস্পতিবার স্টকহলমে সুইডিশ অ্যাকাডেমির ঘোষণা বলে দিল, বাজি জিতে নিয়েছেন ৮২ বছরের অ্যালিসই। অ্যাকাডেমির মতে, ৮২ বছরের অ্যালিস “সমসাময়িক ছোট গল্পের দক্ষ স্রষ্টা।” এর পাশাপাশিই মহিলাদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় ১৩ নম্বরে জায়গা করে নিলেন অ্যালিস।
সেই অ্যালিস, যাঁকে অনেক সমালোচকই বলে থাকেন ‘কানাডীয় চেকভ।’ সুইডিশ অ্যাকাডেমির মতে, মানরোর লেখায় উঠে আসে ছোট শহরের পরিবেশ। যেখানে সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক সময়েই সম্পর্কের ভিতরে তৈরি হয় টানাপোড়েন আর নীতির সংঘাত। প্রজন্মগত ফারাক এবং জীবনের উচ্চাশা থেকে যে ধরনের সমস্যা তৈরি হয়, তা-ও মানরোর লেখার বিষয়। |
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অ্যালিস মানরো। ছবি: এএফপি। |
আন্তন চেকভের মতোই অ্যালিসের গল্পে প্লট ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কারণে তাঁর গল্পে ‘বিশেষ কিছু ঘটে না।’ চেকভের মতো মানরোও সময় নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। সময়ের এগিয়ে যাওয়া যে কখনও, কোনও ভাবেই থমকে দেওয়া যায় না সেই যে চিরকালীন ব্যর্থতা, তা নিয়ে কলম চালান মানরো।
অ্যালিস বলেন, ছোট গল্প লেখাটা ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। মানরোর কথায়, “বহু বছর ধরে ভাবতাম, গল্প লেখাটা আসলে উপন্যাস লেখার আগে প্র্যাকটিসের মতো। তার পর দেখলাম, আমি গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না। সেটা মেনে নিলাম। মনে হয় এত চেষ্টা করেছি, তাই এটাই ক্ষতিপূরণ!”
কিশোরী বয়স থেকেই তিনি ভেবেছিলেন, লেখিকা হবেন। ধারাবাহিক ভাবে লেখার অভ্যেসও তৈরি হয়েছিল। ১৯৬০-এর শেষের দিকে কলম ধরা শুরু। প্রথম স্বামী জেমস মানরোর বইয়ের দোকান চালানো এবং মেয়েদের বড় করার পাশাপাশি লেখা চালিয়ে গিয়েছেন সমান তালে। প্রথম বই, ‘ডান্স অফ দ্য হ্যাপি শেডস’ যখন প্রকাশিত হয়, অ্যালিসের তখন বয়স ৩৭। এখন ওন্টারিওর ক্লিন্টনে থাকেন মানরো। এ বছরের গোড়াতেই লেখা থেকে অবসর নিতে চান বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি বেরিয়েছে তাঁর জীবনীমূলক সংগ্রহ ‘ডিয়ার লাইফ।’
একটা ছোট মেয়ে, কী ভাবে তার ছোট শহরে বড় হয়ে ওঠে, কী ধরনের সঙ্কট তার সঙ্গী হয়, পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক মানরোর প্রথম দিককার লেখায় আসত এমন সব টুকরো মুহূর্তের ছবি। পরবর্তীকালে ‘হেটশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, কোর্টশিপ, লাভশিপ, ম্যারেজ’ বা ‘রানওয়ে’-র মতো বইগুলোতে মানরোর ভাবনা ছুঁয়েছে মধ্যবয়সের সঙ্কট, একা মহিলার জীবন।
তাঁর গল্পের জগতে সাধারণ চরিত্রের ভিড়। যাদের শিল্পকলা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। নেই কোনও ভনিতা বা দেখনদারির কৌশল। আবার একই সঙ্গে তাঁর চরিত্ররা শিল্পের কৃত্রিম দিকগুলো নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। তারা জানতে চায়, কী নিয়ে লেখা হবে? কী ভাবে কেউ লেখে? শিল্পের কতটা অংশ খাঁটি? কী ভাবে একটা গল্প শেষ হবে?
নাকি শেষ হয়েও হবে না শেষ?
এমন নানা সম্ভাবনায় অ্যালিস মানরো গড়ে তোলেন তাঁর গল্পের জগৎ। যে সূক্ষ্ম কৌশলে জীবন, ভালবাসা, মৃত্যু উঠে আসে তাঁর লেখনীতে, সেই কৌশলকেই বৃহস্পতিবার কুর্নিশ জানাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। |