প্যান্ডেলে যেতে হলে গায়ে জ্বর,
মেয়ের মন পাহাড়েই
বীন্দ্রনাথ ভাল লাগে। তবে বেশি প্রিয় নজরুল আর সুকান্ত। সাড়ে ছ’হাজার মিটার ওপরে চড়ে মোবাইলের মেমরি-কার্ডে ভরা রবীন্দ্রসঙ্গীতই তবু শোনা হত।
কী শুনতেন? সখী, ভালবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়!
ভালবাসায় কত যাতনা, তা অবশ্য স্রেফ গান শুনে বুঝতে হয়নি মেয়েটিকে। ভালবাসার টানে প্রাণ হাতে নিতে হয়েছিল যে!
আমার ভালবাসাটা বরাবরই একটু অন্য ধরনের, বুঝলেন। পুজোয় জোড়ায় জোড়ায় বেরোনো, তার পরে পরীক্ষায় ফেল, এ সব কস্মিন কালেও আমার ধাতে সয়নি। ডিমের দোকানে খুচরো ফেরত দেওয়ার ফাঁকে কোন ছেলেটা কখন হাতে চিঠি গুঁজে দিয়েছে, বুঝতেই পারিনি। রাগ উঠে যেত! কাগজটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলতাম।
তবু ভালবাসা ছাড়া আর কী! নইলে বর্ষায় ভাসা এঁদো গলি, ঘুপচি ঘরের মহল্লায় ক’জন সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার স্পর্ধা রাখে?
অত উঁচুতে নেটওয়ার্ক থাকে না। সাড়ে ছ’হাজার মিটারে ক্যাম্প টু-তেই তাই মোবাইলটা রাখতে হয়েছিল। টুসি দাস বলে গিয়েছিলেন, সামিট ছুঁতে পারলে স্যাটেলাইট ফোনে জানাবেন। তখন যেন মোবাইল থেকে কলকাতায় মাকে খবরটা দেওয়া হয়। অঘটন কিছু ঘটলেও ওই মোবাইল থেকেই বার্তা যেত। আঠেরোই মে-র সকালে শুধু ছন্দা গায়েনের শৃঙ্গ জয়ের খবর শুনে টুসির মায়ের বুকটা তাই ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল।
শৃঙ্গের কাছে বরফ গলতে থাকে বিপজ্জনক ভাবে। তখন শনশন হাওয়াও পাগলা হাতির মতো খ্যাপা। এভারেস্ট জয়ের শেষ ধাপটা তাই নিশুত রাতে শুরু হয়। দশ-বারো ঘণ্টা একটানা লড়েই এসপার নয় ওসপার! ষোলো তারিখ রাতেই যে টুসি চুড়ো ছুঁতে বেরিয়ে যাবে, জানতেন সবিতাদেবী। এত ক্ষণ তো লাগার কথা নয়! কী হল তবে?
দমদম পার্ক বাজারের ডিমের দোকানে বসে মা ক্ষণে ক্ষণে আঁচলে চোখ মোছেন। সবিতার চোখে ভাসে ছোট্ট টুসির ছবি। ওদের বাবা তখন সদ্য মারা গিয়েছেন। তিন মেয়ে আর ছোট ছেলেটাকে নিয়ে হিমসিম দশা! পুজোয় কাউকে নতুন জামা দিতে পারেননি। শ্যামনগর রোডের তাঁত কলে নাইট ডিউটি সেরে ফিরে সারা দিন মেশিনে ব্লাউজ, বারমুডা, প্যান্ট সেলাইয়ের ধকল।
ছোট মেয়ে টুসির তখন বড়জোর দশ বছর! নাগেরবাজার কি শ্যামবাজার থেকে ডিম এনে ওইটুকু মেয়েকেই দোকানে বসিয়ে যেতেন। ওর বাবার দোকানটা যাতে বন্ধ না হয়! টুসি কিন্তু ইস্কুল ছাড়েনি। ভূগোলের ক্লাস, এনসিসি-র ক্যাম্প থেকে সবার অজান্তেই বুকের গোপন সিন্দুকে চারিয়ে উঠছিল ভালবাসার হার না-মানা স্বপ্ন।
কতটা ভালবাসলে মৃত্যুর দেশে তে-রাত্তির কাটাতে পারে কেউ? মৃত্যুর দেশই বটে! ছ’হাজার সাতশো মিটার উপরেই তো পোকামাকড়, গাছপালার চিহ্ন থাকে না। আর ক্যাম্প ফোর-এর কয়েক পা উপরে আট হাজার মিটার মানেই ডেথ জোন! দু’-তিন দিনের বেশি অত উঁচুতে বেঁচে থাকা মানুষের কম্মো নয়। প্রথম রাতে সাড়ে আট হাজার মিটার ছাড়িয়ে গিয়েও উত্তাল হাওয়ার মুখে পিছু হটেন টুসি ও তাঁর সঙ্গী পূর্বা শেরপা। অমানুষিক ঠান্ডার ছোবলে তখন টুসির বাঁ গাল ফেটে রস গড়াচ্ছে। ফুলে ঢোল বাঁ চোখ প্রায় বন্ধ। তাই চুড়োর এত কাছে গিয়েও ক্যাম্প ফোরে নেমে আসতে হল।
এই অবস্থায় অনেকেই রণে ভঙ্গ দেবেন। কিন্তু তিরিশ ছুঁইছুঁই টুসি বাংলার এক নম্বর স্পোর্ট ক্লাইম্বার! বিশ্বরেকর্ড করা মেয়ে। গঢ়বাল হিমালয়ের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ থলয়সাগর জয় করেছেন এক বছর আগেই। টিভি-তে বলেছিল, জাঁবাজ লড়কি! এ গ্রহের আর কোনও নারীর এই সাফল্য নেই। গালে ব্যান্ডেজ বেঁধে টুসি তাই মন শক্ত করলেন।
আরও দু’রাতের অপেক্ষা। উনিশে মে এল সেই অলৌকিক ভোর! ক্যাম্প টু-র এক শেরপা মারফত ফোনে খবরটা বেলাবেলি নেমে আসে কলকাতায়। শ্যামনগর রোডের দেড়খানা ঘরের বাসায় তখন হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে।
বন্ধ তাঁতকলের বেরঙিন কোয়ার্টার। বারো ঘর, কমন বাথরুমের মহল্লা। আধবেলার বৃষ্টিতেই হাঁটুজল। এক বছর আগে কেনা ফ্রিজটা তাই সব সময় চৌকিতে তোলা। সকালে ডিম বিক্রি, বিকেলে সল্টলেকের মাঠটা ঘোড়ার মতো বারবার পাক খেয়ে সে ঘরেই ফিরতেন টুসি। কাছেই দমদম পার্কের হেভিওয়েট পুজো। পুজোয় এ তল্লাটে গমগমে মেজাজ। টুসি কই? পুজো উদ্বোধনের যাবতীয় অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছেন পাহাড়জয়ী কন্যে। “ভিড় ঠেলে প্যান্ডেল, ঠাকুর দেখার নাম শুনলে মেয়ের গায়ে জ্বর আসে। কিন্তু ওর মনটা গৌরীর দেশ হিমালয়েই পড়ে। তা আমার মেয়ের জয়টাও তো অসুর জয়ই হল, বলুন!”
শুধু কি প্রকৃতির সঙ্গে লড়তে হয়েছে? বছরের পর বছর দারিদ্রের উজান ঠেলার লড়াই। এভারেস্ট অভিযানের আঠেরো লক্ষ টাকা কী ভাবে আসবে, তা কলকাতা ছাড়ার দু’হপ্তা আগেও জানতেন না টুসি। সরকারি সাহায্য কিছু জুটেছিল। পাশে দাঁড়ান প্রিয় ‘কাকু’ গ্রুপ-ক্যাপ্টেন সমরজিৎ ধর। বারো আনা টাকাই উঠে আসে বাজারে ডিম কিনতে আসা কাকুদের তোড়জোড়ে। শৃঙ্গ তো দূরের কথা! মেয়ের বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছনোর যুদ্ধটাও কিছু কম ছিল না, জানেন সবিতা।
চার সন্তান— স্বপ্না, সুপর্ণা, টুসি আর সঞ্জয়। তখন বাংলা সিনেমা ‘টুসি’ নিয়ে খুব হইচই। ছোটমেয়ের নামটাই তাই অন্য রকম হল। টুসির কিন্তু পছন্দ ছিল না নামটা। মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত। সবিতা বলতেন, “বিয়ে হয়ে যাবে, নাম দিয়ে হবেটা কী তোর!” অভাবের সংসারে ছোট মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো এক লক্ষ টাকা এভারেস্ট-অভিযানে কাজে এল।
বিয়েতে কিন্তু কানাকড়ি খরচ হয়নি। পাহাড় জয়ের নেশায় ডুবে আর একটি মনও যে কবে জিতে নিয়েছেন, তা খেয়ালই করেননি টুসি। দিল্লি প্রবাসী অনীত সাহার পাহাড়ে চড়ার সংস্থাও এভারেস্ট অভিযানে সাহায্য করেছিল ঠিকই। কিন্তু বিয়ে-ফিয়ের চিন্তা স্বপ্নেও ভাবেননি তখন। এভারেস্টজয়ী মেয়ে কাঠমান্ডু হয়ে কলকাতা ফেরার আগেই ফোনে প্রস্তাবটা পাড়েন অনীত। শুনে টুসি আকাশ থেকে পড়েছেন! তবে চার হাত এক হতে দেরি হয়নি।
দমদম পার্কের গলি শুনতে চায় নতুন বর-বধূর প্রথম পুজোর আগমনী। টুসি হাসেন, আমার আর পুজো! সামনেই বেঙ্গালুরুতে স্পোর্ট ক্লাইম্বিংয়ের ন্যাশনাল। পুজোটা কর্নাটকের বাদামিতে রক ট্রিপেই কেটে যাবে। শেষ কবে পুজোয় ছিলেন কষ্ট করে মনে পড়ে মেয়ের। এখনও রক্তাক্ত করে ছোটবেলার না-পাওয়া, দুঃখিনী মায়ের সংসার, পুরনো ফ্রকে অন্ধকার ঘরের কোণ! সর্বোচ্চ শৃঙ্গে উঠেও গ্লানি হয়, মায়ের জন্য করতে পারিনি কিছুই।
সবিতা বলেন, পুজোয় সবার মেয়ে ঘরে আসে! আমার মেয়ে ব্যাগ গুছোয়। গলির ঘরে-ঘরে পুজোর সাজ, থিমের গালগল্প! এক মাস মায়ের কাছে কাটিয়ে বন্দরের নোঙর খোলে ‘জাঁবাজ লড়কি’। পিছনে পড়ে থাকে উৎসবের শহর।
ভাঙাচোরা ঘরটাকে শৃঙ্গজয়ের পথের বেসক্যাম্প বলে মনে হয় টুসির। যার দেওয়ালময় এক অসম যুদ্ধজয়ের চিহ্ন। বরফের চুড়োয় ঘরের মেয়ে। গালে এভারেস্টের দগদগে আদরের দাগ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.