দলের নেতা-মন্ত্রীরা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন পুজোর সঙ্গে। তবু লোকসভা ভোটের আগে রেলভাড়া বৃদ্ধির হাতিয়ার হাতছাড়া করতে না-চেয়ে পুজোর মধ্যেই পথে নামছে তৃণমূল! রেলের ভাড়া বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ানোর প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পূর্ব রেলের সদর দফতর ফেয়ারলি প্লেস পর্যন্ত মিছিল করবে তৃণমূল যুব কংগ্রেস।
রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সাধারণ ভাড়া না বাড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাড়া বাড়িয়ে রেলের আয়ের পথ দেখাতে গিয়ে রেল ভবন থেকে নির্গমনের পথ ধরতে হয়েছিল দীনেশ ত্রিবেদীকে! এখন পাঁচ রাজ্যের ভোট সামনে। তার পরেই লোকসভা ভোট। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় সরকারকে রেলের ভাড়া বাড়াতে হয়েছে বলে কংগ্রেস নেতৃত্বের যুক্তি। কিন্তু ভোটের পাল্টা যুক্তিতে তাঁর সাম্প্রতিক কেন্দ্র-বিরোধী আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে দলকে রেলভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে পথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
উৎসবের সময় মানুষের অসুবিধা ঘটিয়ে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন করার পক্ষপাতী নন মমতা। কিন্তু ষষ্ঠীর দুপুরে তৃণমূলের যুব সংগঠনের মিছিলে সাধারণ মানুষের নাকাল হওয়ারই আশঙ্কা। কংগ্রেস নেতৃত্ব যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন নেহাৎ অনন্যোপায় হয়ে সরকার রেল ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়েছে, তেমনই তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বুধবার বলেছেন, “মানুষের অসুবিধা হবে জেনেও আমরা বাধ্য হচ্ছি পথে নেমে প্রতিবাদ জানাতে। আমরা রেল ভাড়া বৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করছি।” তৃণমূল অন্দরের খবর, কংগ্রেসকে এক ইঞ্চি জমি কোনও অবস্থাতেই ছাড়া হবে না বলে দলনেত্রীর নির্দেশ মেনেই তৃণমূল নেতৃত্ব পুজোর মধ্যে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুকুলবাবু জানিয়েছেন, পুজোর বাকি চার দিন অবশ্য কোনও আন্দোলন হবে না। পুজো মিটলে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা হবে।
কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করে মুকুলবাবু বলেন, “ভারত সরকার অনৈতিক ও অন্যায় ভাবে মানুষের উপরে করের বোঝা চাপিয়েছে। এর আগে পেট্রোল, ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে।” এখন দুর্গোৎসব। নবরাত্রি চলছে। এর পরেই দশেরা, ঈদ আসছে। উৎসবের আমেজের মধ্যে কেন রেল ভাড়া বাড়ল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুকুলবাবুর বক্তব্য, “ভারত সরকার ৮ মাসে তিন বার মানুষের উপরে অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়েছে। বাজেটে পেশ না করে এখন অন্যায় ভাবে রেলভাড়া বৃদ্ধি করছে!” তাঁর অভিযোগ, এর আগে রেলের পণ্য মাশুল ৫.৭% বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে রেল ও মেট্রোর ভাড়া বৃ্দ্ধি করা হল। তিনি বলেন, “মেট্রো রেলের দমদম থেকে গড়িয়ার ভাড়া যেখানে ১২ টাকা ছিল, তা এক লাফে ২৫ টাকা করা হয়েছে!” বাড়তি ভাড়া না দেওয়ার জন্যও মুকুলবাবু যাত্রীদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন।
তৃণমূল প্রতিবাদের পথে হাঁটলেও কংগ্রেস সূত্রের বক্তব্য, লোকসভা নির্বাচন যত কাছে আসবে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ততই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই ভোটের যথেষ্ট আগেই এমন কিছু ‘অপ্রিয়’ পদক্ষেপ সেরে নেওয়া হচ্ছে। অবশ্যই এর ফলে পাঁচ রাজ্যের ভোটে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু রেল মন্ত্রকের ভাঁড়ে যে মা ভবানী! রেলের চাকা গড়াতে হলে এই সংস্কারের পথ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
তেলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, রেলের ভাড়া বাড়ানোকেও তার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, আগে তেলের দাম বাড়লে তুমুল হইচই হত। কিন্তু এখন প্রতি দু’সপ্তাহেই এই দামের ওঠাপড়া মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে কিছুটা। রেলভাড়া বাড়ার প্রয়োজনীয়তার দিকটিও মানুষ ক্রমশ বুঝতে পারবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, ভাড়ার ৩০% খরচ হয় জ্বালানির পিছনে। পরিসংখ্যান বলছে, গত দু’বছরে রেলের জ্বালানি বাবদই খরচ হয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। প্রতি বছর রেল একলপ্তে এই জ্বালানি কিনে থাকে। তবে তার জন্য দামে কোনও ছাড় তারা পায় না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, যোজনা কমিশনও ভাড়া বাড়ানোর পক্ষেই গত কয়েক বছর ধরে সওয়াল করে এসেছে। মেট্রো রেলেও ভাড়া বাড়ানোর কথা চলছে গত ১৪ বছর ধরে! শেষ পর্যন্ত যখন মেট্রো চালানোর ‘অপারেটিং রেশিও’ খুব করুণ জায়গায় পোঁছেছে, তখনই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন মেট্রোর ১০০ টাকা আয় করতে হলে ৩০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে!
মুকুলবাবুরা তাঁদের যুক্তিতে অনড়। তাঁর বক্তব্য, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন দেখিয়েছিলেন ভাড়া না-বাড়িয়েও রেলের আয় বাড়ানো যায়। আমিও কিছু দিন রেলের মন্ত্রী ছিলাম। ভাড়া বাড়ানো হয়নি।” এসইউসি বিধায়ক তরুণ নস্করের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এ দিনই মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজারের কাছে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন। |