মঙ্গলবার প্রাতর্ভ্রমণের সময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন রায়গঞ্জের চিত্রশিল্পী দীপঙ্কর চাকি। মেঘমুক্ত আকাশে রূপোলি চকচকে পাহাড়ের রেখা। তবে কী কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে! তাও রায়গঞ্জে! বেশ কিছুক্ষণ বিশ্বাসই করতে পারেননি দীপঙ্করবাবু। রূপোলি চকচকে রেখা যে কাঞ্চনজঙ্ঘাই, বুঝতে পরে আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করেননি তিনি। বাড়ি গিয়ে ক্যামেরা এনে ছবি তুলতে শুরু করেন। আদৌও সত্যিই রায়গঞ্জ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে কিনা তা পরখ করতে অমিতাভ দত্ত রায়গঞ্জের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ার্স অ্যান্ড ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের দফতরে টেলিফোন করে জেনে নেন।
ঘটনা হল, রায়গঞ্জ শুধু নয়, এদিন আলিপুরদুয়ার, বারোবিশা এমনকী অসম সীমান্ত থেকেও ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্গা দেখেছেন বাসিন্দারা। পাহাড় লাগোয়া দার্জিলিং অথবা জলপাইগুড়ি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া বাসিন্দাদের কাছে নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে প্রায় দু’শো কিলোমিটার দূরের রায়গঞ্জ অথবা আলিপুরদুয়ারের অসম লাগোয়া এলাকা থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে বাসিন্দারা নিজেদের উচ্ছাস সামলে রাখতে পারেননি। রায়গঞ্জের বাহিন, সোহারাইমোড়, কুলিক পক্ষীনিবাস, আব্দুলঘাটা ও কর্ণজোড়া এলাকায় বাসিন্দাদের মোবাইলের ক্যামেরায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে। |
যদিও আবহাওয়াবিদরা এই ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলতে রাজি নন। আকাশ মেঘমুক্ত থাকা এবং উত্তরবঙ্গে সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়াতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয় বলে তাঁদের অভিমত। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের সিকিমের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, “আন্দামানের উপরে ঘনীভূত হওয়া গভীর নিম্নচাপের কারণে উত্তরবঙ্গের আকাশ থেকে মেঘ সরে গিয়েছে। সে কারণেই আকাশের দৃশ্যমানতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি গত কয়েকদিন হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হওয়ায় বাতাসে বেশি ধূলিকনা ছিল না। তাতেও দৃশ্যমানতা কয়েকগুন বেড়ে যায়। মরসুমের এই সময়টা প্রতিবছরই দৃশ্যমানতা বেড়ে গেলেও, এ বছর আন্দামানের নিম্নচাপ মেঘ টেনে নেওয়ায় দৃশ্যমানতা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বেশি ছিল।”
আন্দামানের উপরে থাকা যে নিম্নচাপ দক্ষিণবঙ্গে মেঘ-বৃষ্টির ভ্রুকুটি জারি রেখেছে, সেই নিম্নচাপই উত্তরবঙ্গকে মেঘমুক্ত করে, কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপোলি বিচ্ছুরণ উপহার দিয়েছে উত্তরবঙ্গবাসীকে। পুজোর মুখে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে পুজো-উপহার হিসেবেই দেখছেন রায়গঞ্জবাসী। |
নেপাল এবং সিকিমের সীমান্তে অবস্থিত ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট উচ্চতার কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। ১৯৫৫ সালের ২৫ মে প্রথম এই চির তুষারাবৃত শৃঙ্গে আরোহন করেন দুই ব্রিটিশ নাগরিক। তারপর অসংখ্যবার ওই শৃঙ্গ জয় করলেও পর্বতারোহীদের কাছে যেমন এর আকর্ষণ কমনেনি, তেমনিই শিলিগুড়ি বা কলকাতা কোনও এলাকার বাসিন্দাদের কাছেই এর টান কমেনি। যদিও নথি বলছে একসময়ে উত্তরবঙ্গে সব এলাকা থেকেই কাঞ্চনজঙ্গা দেখা যেত। বাংলাদেশের রংপুর থেকে অসমের ধুবরির আকাশেও পর্বতশৃঙ্গের দেখা মিলত। ক্রমশ দূষণ বাড়তে থাকায় আকাশ দৃশ্যমানতা হারিয়ে যাওয়ায় পাহাড় থেকে দূরবর্তী উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনপদ থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা হারিয়ে গিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের প্রধান সুবীর সরকার বলেন, “রায়গঞ্জ বা অন্যত্র এলাকা থেকে কাঞ্চনজঙ্গা দেখতে পাওয়া বিরল কিছু নয়। বাংলাদেশের রংপুর থেকেও শীতের মরসুমে আগে কাঞ্চনজঙ্গা দেখা যেত। বাতাসে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় এতদিন দেখা যেত না। মঙ্গলবার ঘটনাচক্রে মেঘমুক্ত আকাশের পাশাপাশি, ধূলিকনামুক্ত বাতাসও ছিল। তাই দেখা গিয়েছে।”
হিমালয়ান নেচার এন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “এক সময়ে আমরা যখন কাঞ্চনজঙ্গায় ট্রেকিং করতে যেতাম তখন রাতের বেলায় সেখান থেকে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জনপদের আলো দেখা যেত। এখন দূষণের কারণে তা সম্ভব হয় না। একই ভাবে সমতল থেকেও কাঞ্চনজঙ্গা দেখা যায় না। প্রায় ত্রিশ বছর পরে মঙ্গলবার উত্তর দিনাজপুর থেকে বারোবিশা, অসম লাগোয়া কুমারগ্রাম থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গিয়েছে।”
|