ফি পুজোয় বলতেন,
তোমরা আর মানুষ হলে না!
ফিস থেকে ফেরার পথে মিনিবাসের জানলায় তাকায় তনুশ্রী। ডায়মন্ড হারবার রোডের বিখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যাম। চৌরাস্তা থেকে ম্যান্টন—কেনাকাটার ভিড় উপচে পড়ছে। কলেজের বন্ধুদের আড্ডাতেও খালি শপিংয়ের গল্প। পৃথা-সুকন্যাদের নাছোড় আবদার, তোকে কিন্তু একদিন আমাদের সঙ্গে বেরোতেই হবে। সিনেমা যাবি? পিৎজা?
তনুশ্রী আলতো হাসে। চাকরি পাওয়ার পরে এই প্রথম পুজো!
সদ্য লায়েক মেয়ের পুজো। সে একটু থেমে বলে, চলি রে! মা চিন্তা করছে।
আলোয় ভাসা শহরে ঠাকুরপুকুর সারদাপল্লির রংহীন বাড়িটা পরিত্যক্ত মণ্ডপের মতো তাকিয়ে। এই পুজোয় দোতলাটা শেষ হওয়ার কথা ছিল। বড় ভালবেসে একটু-একটু করে সাজাচ্ছিল বাবা। বাহারি খোপ-কাটা প্রশস্ত রান্নাঘর, ভাইবোনের পড়ার ঘর, ঝুলবারান্দা। স্ত্রী মিনতিকে ডেকে সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী মাঝেমধ্যেই বলতেন, আর ক’দিন! ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে যাচ্ছে! বাকি জীবনটা তোমাতে-আমাতে এই বারান্দায় বসেই কাটবে। তখন দিনভর মিস্ত্রির ঠোকাঠুকি চলছে। বাথরুমের ফিটিংসের সরঞ্জাম এনেছিলেন বোঝাই করে। সে-সব এখনও ডাঁই হয়ে তেমনই পড়ে।
কাজের জায়গার কথা বাড়িতে বলতে একদম ভালবাসত না লোকটা। লক-আপে জেরার গল্প বা দুষ্কৃতীদের ধরতে ‘রেড’ নিয়ে রা কাড়া নেই। পুলিশের উর্দি পরে অহেতুক পাড়ায় ঘোরা নেই বলছিলেন মিনতি। সে-দিন সকালে আচমকা ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি গার্ডেনরিচে ডিউটিতে যেতে হয়। কলকাতা পুলিশের সাদা রঙের ইউনিফর্মের উপরে হাল্কা সবুজ ফুলশার্টটা চাপিয়ে বেরিয়েছিল। সব পোশাক, মানিব্যাগ ফিরে এসেছে। কিন্তু রক্তমাখা উর্দিটা রাখা যায়নি। শার্টটা এখন কেচেকুচে আলমারিতে তোলা। মিনতি মাঝেমধ্যে বার করেন। ইস্ত্রির ভাঁজ খুলে আদর করে হাত বোলান!
কেন যে মোবাইল ফোনটা বাঁ পকেটে রেখেছিল কে জানে! ডান পকেটে থাকলে বোধহয় বিঁধত না গুলিটা। মিনতি বলে ওঠেন, বাড়িতে আমাদের কারওরই টিভিতে অত খবর দেখার বাতিক ছিল না। হরিমোহন কলেজে কী ঘটছে, বোমাবাজি হচ্ছে কিছুই জানতাম না। একটা কলেজের ভোটের ডিউটিতে বেঘোরে প্রাণ যাবে, কী করে ভাবব! কলেজের ডিউটি বলেই তো সার্ভিস রিভলভারটাও সঙ্গে নেয়নি।
ঘরের ফ্রেমে বাঁধানো লালবাজারের প্রশংসাপত্র। ‘অসমসাহসী সহকর্মী’কে কুর্নিশ। মিনতি বলতে থাকেন, এ-সব লেখার বদলে যদি মানুষটা থাকত! আজকাল তো শুনি কত পুলিশ জখম হয়ে দিনের পর দিন হাসপাতালে শুয়ে। আচ্ছা, বুকে না-লেগে গুলিটা তো হাতেও লাগতে পারত, বলুন। না-হয় হাত কিংবা পা-টা যেত! তবু লোকটা তো থাকত। আমাদের গার্জেন!
প্রতি বার পুজোয় বাড়ির এই অভিভাবকের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বেধে যেত বৌ-ছেলে-মেয়ের।
সত্যি তোমরা আর মানুষ হলে না! সারা রাজ্যের লোক বেহালায় আসছে! এ সব ছেড়েছুড়ে কেউ পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকে!
মিনতিও ছাড়ার পাত্রী নন। ক-ত ঠাকুরই দেখাচ্ছ, আমাদের।
নিজে রাত পুইয়ে একডালিয়া-মহম্মদ আলি পার্কে ডিউটি করেই খালাস। আমাদের জন্য পুজোয় সময় আছে তোমার?
কল্যাণীর পরের স্টেশন মদনপুরে মিনতির বাপের বাড়ির উঠোনেই পাড়ার পুজো। দিন-রাত গান, হুল্লোড়, ফাংশন লেগেই আছে। অষ্টমীর দুপুরে স্বামী ভাত খেয়ে ডিউটিতে বেরোতে না-বেরোতেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ট্রেন ধরতেন মিনতি। এখন মনে হয়, ফাঁকা বাড়িতে ফিরতে বোধহয় ভাল লাগত না লোকটার। বাড়ির মাছভাত ছাড়া কিছু যে মুখে রুচত না।
এ বার কলকাতায় পিছুটান নেই। তবু শূন্য বাড়িটা ছেড়ে যেতে পা সরছে না।
ক্লাস নাইনের তমাল বলে, “তখন অপেক্ষায় থাকতাম, কখন বাবা ডিউটিতে বেরোবে। একটু টিভি দেখব। ছাদে ঘুড়ি ওড়াব। এখন বাবার ভয় নেই। পড়ায় ফাঁকি দিলে বাবার দু’ঘা নেই। ভোররাত্তিরে ডিউটি থেকে ফেরা বাবার সঙ্গে পুজোর সকালে পাড়ার প্যান্ডেলে যাওয়াও নেই।
কিছুই ইচ্ছে করে না।” চোদ্দো বছরের দামাল কৈশোর এখন আপনিই থম মেরে গিয়েছে।
পুজোর বাজার নিয়ে লোকটার উৎসাহে কমতি ছিল না। কিন্তু ছেলেমেয়ের বায়নায় প্রশ্রয় নেই এতটুকু। স্ত্রী কদাচিৎ পার্লারে গেলেও খোঁচা। যার নিজের কোনও শখ-আহ্লাদ নেই, অন্যেরটা কী বুঝবে! মিনতি বলেন, আমাদের বিস্তর ঝগড়া ছিল। এখন কিছুই নেই।
সরস্বতী পুজোর ঠিক আগে তাপসবাবু চলে গিয়েছেন। আর তাঁর শয্যাশায়ী মা বিশ্বকর্মা পুজোর ক’দিন আগে। লোকটা মা অন্ত-প্রাণ ছিল। মায়ের শেষ কাজটা ওর করা হল না। চোখ ফেটে জল আসে মিনতির।
সব থেকে কষ্ট হয় মেয়ের দিকে তাকাতে। মুখ্যমন্ত্রী মিনতিকেই বলেছিলেন চাকরিটা নিতে। কিন্তু তা হলে ছেলেটার পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়ার দিকে কে দেখত? তাই কলেজপড়ুয়া মেয়েকেই পাঠাতে হল। বাবার স্বপ্ন ছিল, মেয়ে আইপিএস অফিসার হবে। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে সে এখন ভেরিফিকেশন রিপোর্টের ফাইল দেখে। বাবার বয়সী সহকর্মীরা সস্নেহে বলেন, তোকে অত ক্ষণ থাকতে হবে না। আমরা বুঝে নেব। ১৯ ছুঁই-ছুঁই বয়সের মর্যাদাবোধ তা মানতে পারে না। কলেজের খুব দরকার ছাড়া সচরাচর বিকেলের আগে অফিস ছাড়ে না তনুশ্রী। মাস গেলে মাইনেটা মায়ের হাতে তুলে দেয়।
আশ্বাসমাফিক নিহত পুলিশ অফিসারের প্রাপ্য টাকা, পেনশন আসতে আরও খানিক সময় লাগবে। মেয়ের মাইনের ক’টা টাকা বড় দরকার। গলার স্বর নিচু করে মেয়ের কথা বলতে থাকেন মিনতি। সকাল-সন্ধে কোচিং, দুপুরে অফিস! আর কোনও জীবন নেই মেয়েটার। এই বয়সটা তো বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, হইহইয়েরও বয়স। এখনই সংসারের জোয়াল মেয়েটার ঘাড়ে এসে পড়ল।
শরৎ-সন্ধের হিম জমে সারদাপল্লির ঘরটায়। কুঁকড়ে-থাকা তিনটি প্রাণীর দিকে তাকান ফ্রেম-বন্দি অভিভাবক তাপস চৌধুরী।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.