দুই বা চার ইউনিট চাইলেও মেলে মাত্র এক ইউনিট। অথচ গত ১৫ দিনে মানিকতলার কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্ক
থেকে প্রায় ১২০০ ইউনিট রক্ত বেমালুম ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়াতেই ওই রক্ত ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু সময়সীমা ফুরোনোর আগেই কেন ওই রক্ত কাজে লাগানো হয়নি, সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
দুর্গাপুজোর মরসুমে রাজ্য জুড়ে এমনিতেই রক্তদান শিবির অনেক কমে যায়। ফলে রক্ত পেতে হিমশিম খেত হয় রোগীর আত্মীয়স্বজনকে। এই অবস্থায় পূর্বাঞ্চলের ‘মডেল ব্লাড ব্যাঙ্ক’-এর সম্মানপ্রাপ্ত মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে কেন এমন ঘটনা ঘটল, তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ।
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, ওই রক্ত ফেলে দেওয়া হয়েছে অবৈজ্ঞানিক ভাবে। নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ-উত্তীর্ণ রক্ত অটোক্লেভ মেশিনে দিয়ে নষ্ট করার কথা। কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে একটি অটোক্লেভ মেশিন থাকলেও তা অচল। তাই দোতলায় ডাক্তারদের ঘরের লাগোয়া শৌচাগারে বাতিল রক্ত জমিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে স্বাস্থ্য দফতর নিযুক্ত ‘ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’ সংস্থা রক্তের সেই প্যাকেটগুলি নিয়ে গিয়েছে।
সংগৃহীত রক্ত নষ্ট হয় কত দিনে?
চিকিৎসকেরা জানান, সংগ্রহের পর থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত রক্ত ব্যবহার করা যায়। তার পরেই রক্তের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই সংগ্রহের ৩৫ দিনের মধ্যেই রক্ত ব্যবহার করতে হয়। প্রশ্ন উঠেছে, ১৫ দিনের মধ্যে এত রক্তের সময়সীমা উত্তীর্ণ হয়ে গেল কী ভাবে? যে-রক্তের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, আগে তা রোগীর পরিজনদের দেওয়া হয়নি কেন?
কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা সৌরীন্দ্রনাথ গুছাইতের ব্যাখ্যা, “চাহিদা আর জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য না-থাকাতেই কিছু রক্তের মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে। আজকাল বিভিন্ন সংস্থা ঢালাও রক্তদান শিবির করে চলেছে। এত রক্ত প্রয়োজন হচ্ছে না। তাই রক্ত ফেলে দিতে হচ্ছে।”
দীর্ঘদিন রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অপূর্ব ঘোষ, দীপঙ্কর মিত্রের মতো অনেক কর্মীই সৌরীন্দ্রবাবুর এই বক্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, রক্তের জোগান প্রয়োজনের থেকে বেশি হয়ে গিয়েছে, এই দাবি ঠিক নয়। বরং একে উৎসবের মরসুমে রক্তদান শিবির কমে গিয়েছে। তার উপরে রক্ত সংগ্রহের ব্যাগ ও হেপাটাইটিস-সি পরীক্ষার কিটের অভাবে গত এক মাসে রক্ত সংগ্রহ রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছে। একের পর এক শিবির বাতিল করা হচ্ছে।
বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতার নীলরতন সরকার, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ কোথাও টানা ১০ দিন, কোথাও ১৫ দিন হেপাটাইটিস-সি কিটের অভাবে রক্ত পরীক্ষা করা হয়নি বলে অভিযোগ। ওই সব মেডিক্যাল কলেজের এক-একটির আওতায় ১০-১২টি ছোট ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে। সঙ্কটে পড়ছে তারাও। ওই সব হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত না-পেয়ে মানুষ ছুটছেন কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে। তাই সেখানে রক্তের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের চাহিদা কমে গিয়েছে বলে সৌরীন্দ্রবাবু যে-যুক্তি দেখাচ্ছেন, তা ধোপে টেকে না বলে রক্ত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ কর্মীর দাবি।
তা হলে এত রক্ত নষ্ট হল কেন?
কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মী-অফিসারদের একটা বড় অংশ বলছে, আসলে মেডিক্যাল অফিসার ও টেকনিশিয়ানদের একাংশের অপদার্থতায় ১২০০ ইউনিট রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে এসে কাউন্টারে কেউ দুই বা চার ইউনিট রক্ত চাইলে তাঁকে এক ইউনিট দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এ ভাবেই রক্ত জমেছে এবং নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
দু’চার ইউনিট রক্ত চাওয়া সত্ত্বেও মাত্র এক ইউনিট দেওয়া হয় কেন?
সৌরীন্দ্রবাবুর জবাব, “প্রয়োজন না-থাকলেও অনেক চিকিৎসক বেশি রক্ত চেয়ে পাঠান। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। সকলকে বেশি রক্ত দিয়ে দিলে রক্তের অভাব দেখা দিতে পারে। তাই আমরা সাধারণত দু’-এক ইউনিটের বেশি দিই না।”
রক্ত জমাতে গিয়েও তো তা নষ্ট হল। সেটা কি উচিত?
সৌরীন্দ্রবাবু বলেন, “ঘুরেফিরে যে-দিকে যাবেন, সেখানেই বিপদ।” |