রাস্তা উপর ঝুলছে বড় ব্যানার। দুর্গার ছবির নীচে লেখা ‘ঘাটবেড়া-কেরোয়া আঞ্চলিক দুর্গাপুজো কমিটি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে’। পাশে দুর্গার স্তোত্র।
অথচ পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়তলির ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েত অফিসের কাছে এই কুমারডি মোড়ের দোকানের দেওয়ালগুলো এক সময়ে মাওবাদীদের পোস্টারে ছয়লাপ হয়ে থাকত। গত পাঁচ বছরে মাওবাদী নাশকতায় এখানে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এই পঞ্চায়েত এলাকায় অন্তত ২৩টি মাওবাদী নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। একটা সময় এই এলাকা ছিল মাওবাদীদের ‘মুক্তাঞ্চল’। |
আজ সেই ঘাটবেড়াতেই বদলের ছবি। জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হেদেলবেড়া, খুনটাঁড়, মাহিলিটাঁড়, কেরোয়া, তিলাই, সেরেংহাতু, ছতরাজেরার মতো ছোট ছোট টোলায় এখন উৎসবের আমেজ। এ বারই যে প্রথম দুর্গাপুজো হচ্ছে এখানে! একটা-দু’টো নয়, পাহাড় ও পাহাড়তলির ৫৪টি গাঁয়ের লোক এক হয়ে দুর্গাপুজোয় মেতেছেন। তাঁদের সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুজোর তদারকি করছেন বর্তমানে জামিনে মুক্ত মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের প্রাক্তন এরিয়া কমান্ডার নন্দ কুমারও।
বস্তুত, ২০১১ সালের নভেম্বরে মাওবাদীদের হাতে কয়েক জন তৃণমূল কর্মী খুন হওয়ার পরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। শাসকদলের সমর্থনে মাওবাদীদের দিকে ঝুঁকে যাওয়া স্থানীয় ছেলেমেয়েদের ঘরে ফেরার ডাক দিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। জঙ্গলে তল্লাশি বাড়ায় যৌথবাহিনী। অযোধ্যা স্কোয়াডের অনেক সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। বিক্রম ওরফে অর্ণব দামের মতো শীর্ষ মাওবাদী নেতা পুলিশের হাতে ধরা পড়তেই শান্তি ফেরে অযোধ্যা পাহাড়ে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঘমুণ্ডিতে জনসভাও করেছেন।
কুমারডি মোড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মণ্ডপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ। সকাল থেকে সেখানে ভিড় জমাচ্ছে কচিকাঁচারা। উৎসাহে খামতি নেই বড়দেরও। বাঘমুণ্ডির ছৌ-মুখোশের গ্রাম চড়িদার শিল্পী বিমল সূত্রধর প্রতিমা তৈরি করতে করতে বলছিলেন, “আগে কত জায়গায় প্রতিমা করতে গিয়েছি। কিন্তু এখানে প্রতিমা তৈরি করার অভিজ্ঞতাটা অন্য রকম। কে বলবে এই সেই ঘাটবেড়া-কেরোয়া!” এক পুজো উদ্যোক্তার কথায়, “২০০৭ সাল থেকে মাওবাদীদের দৌরাত্ম্যে এলাকায় শান্তি ছিল না। বিয়ের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠানও কোনওরকমে সারতে হত। দুর্গাপুজো করার কথা ভাবতেও পারতাম না!” পুজো কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা দেবরাজ মাহাতো বলেন, “পুজো করার ইচ্ছা অনেক দিন ধরেই ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। তাই সবাই মিলে এ বছর থেকেই পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।”
এত দিন এখানকার মানুষদের পুজোর দিনগুলো কাটত বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই। পুজো হয় ব্লক সদর বলরামপুরে, কিংবা অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায়। পুজো হত পুরুলিয়া-বলরামপুর সড়কের ধারে উরমাতেও। কিন্তু সে পথও তো কম নয়! এ বার তাই রথযাত্রার দিন থেকেই পুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন ঘাটবেড়া-কেরোয়ার লোকজন। প্রতিটি গ্রাম থেকে প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গড়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি চাঁদা তোলাও চলছে। পুজো কমিটির সম্পাদক অশোক কুমার বলেন, “৫৪টি গ্রামের মানুষ এক সঙ্গে কাজ করছেন। কাজ হু হু করে এগোচ্ছে।” পুজোর চার দিন গান-আবৃত্তির সঙ্গে হবে দাসাই, ঝুমুর, বাউল, ছৌ-নাচেরও মতো লোক সংস্কৃতির অনুষ্ঠানও। আর থাকবে ম্যাজিক-শো।
বলরামপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোর কথায়, “জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরেছে। শুরু হয়েছে পুজো। আমি তো যাবই। অন্যদেরও আসতে বলব।” |