হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে রাজ্য সরকারের শেয়ার কার হাতে যাবে, আজ, সোমবারই তা চূড়ান্ত হবে। সোমবার সকাল এগারোটা থেকে শুরু হওয়া নিলাম প্রক্রিয়া ঠিক করে দেবে নতুন অংশীদারের নাম। শিল্প দফতরের অন্তত এমনটাই দাবি।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, শেষ পর্যন্ত সত্যিই কেউ পেট্রোকেমে সরকারের শেয়ার কিনতে রাজি হলে, দায় নামবে রাজ্যের ঘাড় থেকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিল্প মানচিত্রে অন্যতম ‘শো-পিস’ প্রকল্পের শনির দশা এখনই কাটবে না। কারণ, সংস্থার ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ শেয়ারের মালিকানা কার, তা নিয়ে বিবাদ চলছে। রাজ্য ওই শেয়ার নিজের বলে দাবি করলেও পেট্রোকেমের অন্যতম প্রধান শরিক চ্যাটার্জি গোষ্ঠী সেই দাবি চ্যালেঞ্জ করে মামলা ঠুকেছে। এই বিতর্কিত শেয়ার রাজ্য নিলামে চড়াচ্ছে কিনা, তা নিলামের ২৪ ঘণ্টা আগেও স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় রবিবার বলেন, “কালই তো নিলাম। তখনই জেনে যাবেন। সব কিছু হচ্ছে স্বচ্ছতার শর্ত মেনেই।”
উল্টো দিকে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর পক্ষে অনিরুদ্ধ লাহিড়ির দাবি, “যে শেয়ার সরকারের নয়, তা কী করে নিলামে চড়াবে তারা? এই বিষয়টি তো এখনও আদালতে মীমাংসার অপেক্ষায়!” নিলামের খুঁটিনাটি সম্পর্কে যাঁরা অবহিত, তাঁদের অবশ্য দাবি, সরকার যে শেয়ার বিক্রি করতে চলেছে, তাতে ওই বিতর্কিত শেয়ারও রয়েছে।
অবশ্য জটিলতা শুধু সাড়ে পনেরো কোটি শেয়ার ঘিরে নয়। আজ নিলামে সর্বোচ্চ যে দর উঠবে, প্রথমে সেই দরে সরকারের সমস্ত শেয়ার কিনে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে চ্যাটার্জি গোষ্ঠীকে। তাদের এক মাস সময় দেওয়া হবে হ্যাঁ বা না বলার জন্য (পরিভাষায় যাকে বলা হয়, রাইট অফ ফার্স্ট রিফিউজাল)। তারা না-বললে, তবেই ওই শেয়ার সর্বোচ্চ দরদাতার হাতে যাবে। কিন্তু বিতর্ক দানা বেঁধেছে এখানেও। কারণ, এক মাসের সময়সীমা কী ভাবে নির্ধারিত হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। |
পেট্রোকেমে সরকারের শেয়ার কেনার লড়াইয়ে কোন কোন সংস্থা রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষ সূত্রের খবর, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ (আরআইএল) থাকছেই। আর যে সব নাম আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইন্ডিয়ান অয়েল (আইওসি), ওএনজিসি এবং কেয়ার্ন। অনিরুদ্ধবাবু এ দিন দাবি করেন, “আমরা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। নিলাম কী ভাবে হবে, দরপত্র কাদের সামনে খোলা হবে, কে কত দর দিল তা কারা জানবে সংস্থার অন্যতম শরিক হয়েও আমরা কিছুই জানি না।”
আজ নিলাম পর্ব ভালয় ভালয় চুকলেও পেট্রোকেম নিয়ে বিরোধের দীর্ঘ ইতিহাসে আরও কয়েকটি পাতা যুক্ত হবে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত।
পেট্রোকেমের মালিকানা ঘিরে বিবাদের সূত্রপাত জন্মলগ্ন থেকেই। ৯৬৯ কোটি টাকার শেয়ার বাজারে বেচার কথা থাকলেও এশিয়া বাজারের বেহাল দশার জন্য তা হয়নি। ফলে নির্ধারিত ৩১৯১ কোটি টাকার বাইরে আরও ৯৬৯ কোটি টাকা ধার করতে হয়। সেই ঋণেরই জটিল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০২ সালের ৮ মার্চ রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ শেয়ার দেয় চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর সংস্থা চ্যাটার্জি পেট্রোকেমের (মরিশাস) হাতে। তারা আবার শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছেই ওই শেয়ার বন্ধক রাখে।
সংস্থা সূত্রের খবর, ২০১২ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত পেট্রোকেমের খাতায় ওই শেয়ার কোনও মালিকের নামেই দেখানো ছিল না। কিন্তু সে বছরই ওই শেয়ারের মালিক হিসেবে নথিভুক্ত হয় শিল্পোন্নয়ন নিগমের নাম। এই শেয়ার নিয়ে আগে থেকেই মামলা চলছিল। এ বার এই মালিকানা নথিভুক্ত করার বিষয়টিও তার সঙ্গে যুক্ত হয়। চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর দাবি, তারা তাদের দায় মিটিয়ে দিয়েছে। ফলে ওই শেয়ার তাদের। রাজ্য তা নিলাম করে কী ভাবে? অন্য দিকে, রাজ্য সরকারের বক্তব্য, যারা শেয়ার কিনবে, সব জেনেই কিনবে। আদালত যদি বলে, ওই শেয়ার চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর, তা হলে তারাই তা পাবে। আদালত যে প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করে দেবে, সেটিই তখন মানা হবে।
এ তো গেল যুদ্ধের গল্প। কিন্তু যে সন্তানের মাতৃত্ব নিয়ে এই ধুন্ধুমার, সেই সন্তান কেমন আছে?
এক কথায় ভাল নয়। জাহাজ ডোবার খবর ইঁদুরই প্রথম আঁচ পায় এই প্রবাদ মেনে চাকরি ছাড়তে শুরু করেছেন পেট্রোকেমের কর্মীরা। পরিচালন পর্ষদও সম্প্রতি সংস্থার হাল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হিসাব নিরীক্ষকের মতে, গত আর্থিক বছরে পেট্রোকেমের ক্ষতি দাঁড়ায় ১১৪৮ কোটি ৯০ লক্ষ টাকার উপরে। পাঁচ মাসে তা আরও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বেড়েছে। গত অর্থবর্ষেই সরকারি ভাবে মেনে নেওয়া হয়েছিল যে, ইতিমধ্যেই নিট সম্পদের অর্ধেক খেয়ে নিয়েছে লোকসান। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, খাতায়-কলমে সংস্থার শেয়ারের দাম (বুক ভ্যালু) এখন শূন্য। শেয়ার-পিছু লোকসান ৬ টাকা।
একে মামলার দায়। তার উপর এই আর্থিক হাল। এমন সংস্থার শেয়ার কিনতে আদৌ কেউ আগ্রহী হবে কেন?
উত্তরে ব্ল্যাকবেরির প্রসঙ্গ আনলেন নিলাম ও দর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি লোকসানের ভারে ধুঁকতে থাকা ব্ল্যাকবেরি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন অনাবাসী ভারতীয় প্রেম বত্স। আইআইটি-র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে কানাডার প্রথম সারির ধনকুবের বত্সের যুক্তি, ব্ল্যাকবেরির নানা সমস্যা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যে প্রাণের রসদও রয়েছে। আর তাই লগ্নি করতে চান তিনি। একই সঙ্গে বত্স জানিয়েছেন, ব্ল্যাকবেরির ঘুরে দাঁড়ানো কয়েক মাসের ব্যাপার নয়। চার-পাঁচ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবেন তাঁরা।
পেট্রোকেমের নিলামের সঙ্গে যুক্ত ওই বিশেষজ্ঞও বলছেন, কোনও সংস্থা কেনা হয়, কে কী ভাবে তার ভবিষ্যত্ দেখছেন, তার উপর। তাঁর কথায়, “বিনিয়োগকারী সুযোগ খোঁজে। এই কারখানা যে প্রযুক্তিতে তৈরি, তাতে এখনও এখানে তৈরি পণ্যের গুণমান অত্যন্ত উন্নত। দেশের অনেক সংস্থাই তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। আর সেই কারণেই পেট্রোকেম নিয়ে অনেক সংস্থারই আগ্রহ আছে।” সেই আগ্রহের পরিণতিই আজকের নিলাম। এর পর হলদিয়া নাটকের
জল কোন দিকে গড়াবে, তার ইঙ্গিত মিলবে আজ সন্ধের মধ্যে। তবে শিল্প দফতরের এক কর্তার কথায়, “লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।” |
কার হাতে কত শেয়ার |
• রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম: ৬৭ কোটি ৫০ লক্ষ (বিতর্কিত ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ ধরে)
• চ্যাটার্জি পেট্রোকেম: ৪৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৫৭ হাজার ১৪৮
• উইনস্টার ইন্ডিয়া ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি: ১২ কোটি ৭৪ লক্ষ
• ইন্ডিয়ান অয়েল: ১৫ কোটি
• ইন্ডিয়া ট্রেড (মরিশাস) লিমিটেড: ১০ কোটি ৭১ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৫২ |
সঙ্কটের শিকড় |
• গোড়ায় ঠিক হয়েছিল মূলধনের ১,৯৭৯ কোটি টাকা আসবে শেয়ার বেচে।
চ্যাটার্জি গোষ্ঠী ৪৩৩ কোটি,
রাজ্য সরকার ৪৩৩ কোটি
এবং তত্কালীন অংশীদার
টাটা গোষ্ঠী ১৪৪ কোটি টাকা লগ্নি করবে।
বাকি ৯৬৯ কোটি টাকার শেয়ার বাজারে ছাড়া হবে।
এ ছাড়াও নেওয়া হবে ৩,১৯১ কোটি টাকার ঋণ। |
• কিন্তু এশিয়া বাজারে ধস নামায় শেয়ার বেচা যায়নি। ৯৬৯ কোটি টাকাও
তোলা হয় চড়া সুদে ঋণ করেই।
ফলে বিপুল হয়েছে ঋণের বোঝা। |
• তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মালিকানা নিয়ে বিবাদ। আর মূলধন জোগাড় করা নিয়ে সরকার ও চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর টানাপোড়েন। |
|