অপারেশন জেরোনিমো-র সাফল্যের পুনরাবৃত্তি হল না। দু’বছর আগে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে মেরেছিল মার্কিন সেনার যে দল, সেই ‘সিল টিম সিক্স’ সোমালিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হল শনিবার। সাঁতরে প্রাণ বাঁচালেন মার্কিন সেনারা।
কেনিয়ার নাইরোবি শহরের শপিং মলে জঙ্গি নাশকতার সূত্রে সোমালিয়ার আল-শাবাব গোষ্ঠীর নাম এখন গোটা
|
লিবিয়ায় ধৃত আল-কায়দার নেতা আল-লিবি। |
বিশ্বের কাছেই পরিচিত। ওয়েস্টগেট মলে হামলা চালানোর দায় তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে। ফলে মার্কিন প্রশাসনের সন্ত্রাসদমন অভিযানে আল-কায়দা ঘনিষ্ঠ আল-শাবাব এখন গুরুত্বপূর্ণ নিশানা। কিন্তু অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েও আল-শাবাবের প্রতিরোধের মুখে অভিযান বাতিল করতে বাধ্য হল আমেরিকা। সংবাদ সংস্থা-র কাছে এ কথা স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন সেনা সূত্রই। অন্য দিকে আল-শাবাব তাদের ওয়েবসাইটে ফলাও করে মার্কিন সেনার ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রের ছবি দিয়েছে। জঙ্গি মুখপাত্র মহম্মদ আবু সুলেমান দাবি করেছে, ‘‘ঈশ্বরের শত্রুরা মাঝরাতে হানা দিয়ে মুজাহিদিনদের চমকে দিতে চেয়েছিল। পারেনি। উচিত শিক্ষা হয়েছে ওদের।”
সম্প্রতি সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পরে সেখানে সামরিক অভিযান চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে এবং রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সে পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হন তিনি। ইতিমধ্যে মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমা সংক্রান্ত মতবিরোধের জেরে তালা পড়েছে মার্কিন প্রশাসনে। এই পরিস্থিতিতে শনিবার একযোগে সোমালিয়া এবং লিবিয়ায় অভিযান চালায় মার্কিন বাহিনী। কূটনীতিকদের বড় অংশের মতে, এই ভাবেই বিদেশনীতিতে কিছুটা আগ্রাসী চমক এনে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাইছিলেন ওবামা। কিন্তু তাঁর সাধ পূরণ হল না। লিবিয়ায় আল কায়দার অন্যতম শীর্ষ নেতা আনাস-আল লিবিকে ধরা গেলেও সোমালিয়ায় মুখ পোড়াল ‘সিল টিম সিক্স’। |
আল-শাবাব জঙ্গিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। সোমালিয়ায়। |
শনিবার বেশ ভোরেই রাজধানী মোগাদিসু থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে, দক্ষিণ সোমালিয়ার বন্দর শহর বারাওয়ে-তে ঢুকে পড়ে পজিশন নিয়েছিল ‘সিল টিম’। গোটা শহরটাই এমনিতে আল-শাবাবের নিয়ন্ত্রণে। তার মধ্যেই একটি বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে তাদের শীর্ষনেতা, এমনটাই খবর ছিল মার্কিন বাহিনীর কাছে। এই মুখতার আবু জুবেইর ওরফে আহমেদ গোদানে-ই ওয়েস্টগেট-কাণ্ডের পাণ্ডা। হামলার দায় স্বীকার করেছিল সে-ই। সোমালি গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, গোদানে-কে নিকেশ করাই মার্কিন সেনাদের লক্ষ্য ছিল।
সেই মোতাবেক শনিবার অন্ধকার থাকতেই হেলিকপ্টার এবং স্পিডবোট নিয়ে তিন তলা বাড়িটায় ঢুকে পড়ে মার্কিন বাহিনী। উদ্দেশ্য ছিল, জঙ্গিরা ভোরের প্রার্থনার জন্য ওঠার আগেই তাদের ঘায়েল করা হবে। কিন্তু বিষয়টা যত সহজ হবে মনে করা গিয়েছিল, বাস্তবে ঘটল তার উল্টো। পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লাদেনের ঘাঁঁটিকে যে ভাবে কব্জা করা গিয়েছিল, এখানে তা আদৌ ঘটেনি। জঙ্গিরা দ্রুত মেশিনগান নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করে। ১৫-২০ মিনিট গুলির লড়াই চলার পরেই মার্কিন ইউনিট লিডার বুঝে যান, অবস্থা বেগতিক। সাঁতরে পালানোই শ্রেয় বলে স্থির করেন তাঁরা।
মার্কিন সূত্রে এর একটা অন্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও অবশ্য হয়েছে। জনৈক সেনা অফিসার বলেন, কোনও মতেই নিরীহ মানুষের মৃত্যু যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছিলেন তাঁরা। সে জন্যই একটা সময়ের পর অভিযান বাতিল করা হয়। আল-শাবাবের কিছু সদস্য হতাহত হয়েছে বলেও তাঁর দাবি। কিন্তু কে বা কারা হতাহত হল, তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কেউ রয়েছে কি না, সেটা স্পষ্ট নয়। সোমালি পুলিশ বলছে, সাত জন নিহত হয়েছে। আল-শাবাব
বলছে, তাদের এক জন মারা গিয়েছে। মার্কিন সেনা সূত্রেও স্পষ্ট বলা হয়নি, কাকে মারতে তারা গিয়েছিল এবং তাকে মারতে পারা গিয়েছে কি না। তারা শুধু বলছে, কোনও মার্কিন সেনা মারা যায়নি।
বারাওয়ের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অভিযানের সামান্য পরেই জঙ্গিরা গোটা শহরটা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে তারা খোঁজার চেষ্টা করেছে, কোন চর মারফত ঘাঁটির খবর ফাঁস হল।
সোমালিয়ায় পর্যুদস্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে অবশ্য লিবিয়ার মাটিতে মার্কিন সেনা বড় সাফল্য পেয়েছে। আল কায়দার অন্যতম
শীর্ষ নেতা আবু আনাস আল লিবি রাজধানী ত্রিপোলি থেকে মার্কিন সেনার হাতে ধরা পড়েছে। বিভিন্ন দেশে জঙ্গি কাজকর্মের পাণ্ডা গত এক বছর যাবৎ নিজের দেশ লিবিয়ায় ছিল। আল কায়দার জন্মের সামান্য পর থেকেই লাদেনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল কম্পিউটার-বিশেষজ্ঞ লিবি। মার্কিন গোয়েন্দার দাবি, ১৯৯৮-এ কেনিয়া, তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমাবর্ষণের মূল চক্রী ছিল লিবি-ই।
শনিবার ভোরের নমাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিল ৪৯ বছরের লিবি। লিবির এক বন্ধু পরে জানায়, ১০ জন মুখোশধারী লোক এসে লিবিকে ঘিরে ধরে। লিবি গাড়ি থেকে নিজের বন্দুকটা আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে আটক করে উধাও হয়ে যায় মুখোশধারীরা। এতটাই নিঃশব্দে যে, প্রতিবেশীরা প্রথমে একে অপহরণ ভেবেছিলেন।
পরে জানা যায়, লিবিয়ার সরকারের সঙ্গে কথা বলেই হানা দিয়েছিল মার্কিন সেনা। তবে ত্রিপোলির বাসিন্দাদের একাংশ এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের কাছে এই মুহূর্তে লিবি-হরণের সাফল্য কাহিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেন্টাগনে এমনিতে তালা ঝুললেও জোড়া অভিযানের স্বার্থেই শনিবার কর্মীদের কাজে ডাকা হয়েছিল। মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি রবিবার তাও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “আমেরিকা যে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান থামাবে না, তা নিশ্চয়ই পরিষ্কার।
কিন্তু সোমালিয়া দেখিয়ে দিল, পেন্টাগন যত গর্জায় সব সময় তত বর্ষায় না। |