|
|
|
|
ফুটবল কাফে |
তিরিশ মিনিটের একটা ফুটবল ম্যাচ। কোচ? জাতীয় চলচ্চিত্রের মঞ্চ
দাপানো পরিচালক সুজিত সরকার। লিখছেন দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় |
এই মুহূর্তে ময়দানের সবচেয়ে সিরিয়াস বাঙালি ফুটবল কোচ কে? সুব্রত ভট্টাচার্য? সুভাষ ভৌমিক? নাহ্, সুজিত সরকার।
কে তিনি? সাত বা আটের দশকে ময়দানে দাপিয়ে খেলা কোনও ফুটবলার নয়। ফুটবল অবশ্যই খেলেছেন। তবে সেটা ব্যারাকপুরের এয়ারফোর্স মাঠে। খেলেন এখনও। সেটা আবার অভিষেক বচ্চনের দল। তার নির্ভরযোগ্য লেফট হাফ। তার চেয়েও বড় পরিচয় ‘ম্যাড্রাস কাফে’ ছবির সূত্রে গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছেন সুজিত। এ বার তিনি বাংলা ছবি প্রযোজনা করছেন কলকাতার ফুটবল সংস্কৃতি নিয়ে।
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় (চন্দ্রবিন্দু খ্যাত) পরিচালিত দু’ঘণ্টার সেই ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবির নিউক্লিয়াসটাই তিরিশ মিনিটের একটা ফুটবল ম্যাচ। আর তার জন্যই শরতের সকালে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে খুদে ফুটবলারদের ট্রায়াল নিতে মুম্বই থেকে হাজির সুজিত। লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন ছেড়ে শনিবার সকালে সেখানেই তিনি শান দিলেন খুদে ফুটবলারদের স্কিল, স্পিড, সেন্স, শুটিংয়ে।
আর সুজিতের ছবি মানেই তো জীবনের আবেগ-অনুভূতি-মনন এক একটা ক্যানভাসে এক-এক রকম ভাবে জেগে ওঠে। ‘ভিকি ডোনার’-এ যিনি দর্শকদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে দেন, তিনিই আবার গুজরাত নিয়ে অ্যাড ফিল্ম শুটিংয়ের সময় বিগ বি অমিতাভ বচ্চনকে আবেগরুদ্ধ করে ছবির সামনে কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেন। সেই সুজিতই আবার ‘ম্যাড্রাস কাফে’-তে তাঁর জীবনে একটাও অ্যাড ফিল্ম শু্যট না করা ইন্টেলিজেন্স অফিসার জন আব্রাহামকে ছুটিয়েছেন ভারতের প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রে। |
|
এ বার তিনি ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবির জন্য একদম ফুটবল কোচের ভূমিকায়। বাঁশি মুখে জার্সি-প্যান্ট-বুট পরে নেমে পড়েছেন স্টেডিয়ামে। সঙ্গে অনিন্দ্য। বাঙালির অহমিকার অন্যতম বিষয় ফুটবলকে কেন্দ্রে রেখে ছবি করতে নেমে সুজিত-অনিন্দ্য দু’জনেরই মনের ‘রিংটোন’ ‘কোয়ালিটিতে নো কম্প্রোমাইজ’।
পরিচালক হিসেবে অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামার প্রাক-মুহূর্তে অনিন্দ্য বলছেন, “প্রযোজনার বাইরে এই ছবির মূল আকর্ষণ ফুটবল ম্যাচটার যাবতীয় খুঁটিনাটি দেখছে সুজিত। আর সেখানে ও এমন কোনও দৃশ্য চাইছে না, যেখানে দর্শকের মনে হয় ফুটবল ম্যাচ নয়। একটা সিনেমা দেখলাম।” বিডন স্ট্রিটে বেড়ে ওঠা অনিন্দ্য শৈশব-কৈশোরে দেখেছেন স্বাধীনতা দিবস, মহালয়ার দিনে গলি ফুটবলের বিখ্যাত ওয়ান ডে টুর্নামেন্ট। সেই নস্ট্যালজিয়া হাতড়াতে গিয়েই লিখে ফেলেছিলেন ফুটবল ও কলকাতার সমাজজীবনভিত্তিক গল্প ‘একদিন ব্যাপী’। গত বছর বর্ষার এক বিকেলে সুজিতের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে তা নিয়ে প্রসঙ্গ উঠতেই সলতে পাকানো শুরু এই ছবির।
‘আনন্দ প্লাস’-কে ফুটবলপাগল সুজিতের সোজাসাপটা জবাব, “ছবিতে কোনও বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী নেই। বিখ্যাত ওই ফুটবলটাই। বাঙালির ফুটবলপ্রেম নিয়ে যখন ছবি করছি তখন চেষ্টাটা থাকবে ছবিটা দেখার সময় দর্শকরা মাঠের আমেজটা পুরোদমে পেতে পারেন। তাই ফুটবল নিয়ে ওয়ার্কশপ করব।”
আর বহুচর্চিত সেই ফুটবল ম্যাচটা? শুনেই বাঁশি মুখ থেকে সরিয়ে কমলা-কালো জার্সি এবং কালো শর্টস পরা সুজিত মুখ খুললেন। তাঁকে দেখে তখন কে বলবে এই মানুষটাই বিদ্যা বালান, নার্গিস ফকরি, সেফ আলি খান, জন আব্রাহামদের নিয়ে ফ্লোর মাতিয়ে রাখেন। তিনিই এখন কিনা এক ঝাঁক খুদে ফুটবলারকে ড্রিবল থেকে বল জাগলিংয়ের সময় মাথা কতটা ঝুঁকে থাকবে তা দেখাচ্ছেন। গোলের সামনে ইনস্টেপে শট নেওয়ার সময় মাথাটা কত ডিগ্রিতে সামনে ঝুঁকে থাকেব, ব্যালান্সিং ফুটটা বলের পাশে থাকবে কি না সেটাও হাতে-কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন অ্যাভেনিউ সম্মেলনী থেকে ট্রায়ালে আসা ফুটবলারদের।
কত জন খুদে ফুটবলার সুযোগ পাবে এই ছবিতে? রহস্যটা ভাঙলেন সুজিত নিজেই। বললেন, “ফুটবল ম্যাচটা ফুটবল ম্যাচের মতোই থাকবে ছবিতে। তাই ভাল খেলতে পারে এমন পাঁচ-ছ’জনকে এখান থেকে নেব। ওয়ার্কশপ থেকে কয়েক জন আসবে। কেন্দ্রীয় চরিত্র (শত অনুরোধেও নাম বলতে চাইলেন না) সেই ওয়ার্কশপেই ব্যস্ত।
আর পরিচিতদের মধ্যে দু’একজনের ছেলেও রয়েছে।”
এই পরিচিত দু’একজনের মধ্যে সুজিতের কাছে কোচিং নিচ্ছেন ধী মজুমদার, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়রাও। প্রথম জনের বাবা শিলাজিৎ। দ্বিতীয় জন আর তার বাবা শান্তিলাল দু’জনেই অভিনয় করেছেন ‘কহানি’তে। সুজিতের কাছে ছেলের ফুটবল ব্যাকরণ ঝালিয়ে নেওয়া দেখতে সাতসকালেই রবীন্দ্র সরোবরে হাজির ‘কহানি’র সেই সিক্রেট এজেন্ট ‘আর শ্রীধর’ ওরফে শান্তিলাল। বললেন, “সুজিত ফুটবলটা দারুণ বোঝে। টলিউডে ফুটবল নিয়ে এ বার একটা কিছু করবেই।” আর শিলাজিৎ-এর রসিকতা মেশানো আফসোস, “ফুটবল নিয়ে ছবি, আর আমি নেই! অনিন্দ্য নিয়েও বাদ দিল। কেন? ছবিতে ওই চরিত্র সবশেষে ফুটবল খেলে চাকরি পাবে
বলে। বললাম মেক আপ নিয়ে ফুটবল খেলে দেব। কিন্তু তা মানতে না চাইলে আর কী করব!” পরক্ষণেই সিরিয়াস মুডে বললেন, “বিষয়টা কিন্তু ফাটাফাটি। তবে বাবাকে না নিয়ে ছেলেকে ডেকেছে ওরা। চাইব আমার ছেলে যেন অনিন্দ্যর সাফল্যের একটা শরিক হতে পারে। তা হলেই আমি খুশি।”
শিলাজিতের কথা শুনে হাসছেন অনিন্দ্য। আর রণবীর কপূরের ‘মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো’ সুজিত বলছেন, “আরে আমার জীবন জুড়েই তো ফুটবল! দিল্লির মেরিডিয়ান হোটেলে বলুন কিংবা প্রথম সরকারি চাকরি। সবই তো ফুটবল খেলে পাওয়া। নিজে এই বয়সেও এখনও খেপ খেলতে চলে যাই। সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবারেও এ রকম একটা ম্যাচ খেলে এলাম। এখানে প্র্যাকটিস করিয়েই দুপুরের ফ্লাইটে মুম্বই যাচ্ছি। রবিবার ওখানে ম্যাচ। অভিষেক (বচ্চন) বলে দিয়েছে তুমি শুরু থেকেই খেলবে।”
আপাতত ঠিক হয়েছে নভেম্বরে ছবির শুটিং শুরু হবে। যুবভারতী, মোহনবাগান মাঠ-সহ উত্তর কলকাতার একটা বড় অংশ তুলে ধরা হবে সুজিত-অনিন্দ্য যুগলবন্দির এই ছবিতে। যেখানে পাড়া ফুটবল নিয়ে আকচা-আকচি, বাড়ির একমাত্র ছেলের ফুটবল খেলা নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়দের নিষেধাজ্ঞা, পাড়ার দাদাদের সদম্ভ উপস্থিতি, কৈশোরের প্রথম প্রেম সব কিছুর টুকরো টুকরো কোলাজ রয়েছে চিত্রনাট্যে। বিশেষ চরিত্রে দেখা যেতে পারে সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ বেশ কয়েক জন প্রাক্তন ফুটবলারকেও। সুজিত, অনিন্দ্য দু’জনেরই ফেভারিট সুব্রত ‘আনন্দ প্লাস’- থেকে খবরটা শুনেই বেশ উত্তেজিত। বললেন, “ফুটবলার হিসাবে কারও উঠে এসে সফল হওয়া একটা যুদ্ধ। বাঙালি তো এখন সেই যুদ্ধের অধ্যায়টা ভুলেই মেরে দিচ্ছে। সুজিত-অনিন্দ্য সেই জায়গাটা যদি তুলে ধরে, তা হলে আমাদের ফুটবলেরই মঙ্গল। অন্তত সিনেমাটা দেখে যদি দশটা ছেলেও প্রতি পাড়া থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করে, তা হলে আর বাঙালি ফুটবলার নিয়ে হা-হুতাশ করতে হবে না।”
অতীতে ফুটবল নিয়ে ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সপ্তপদী’, ‘সাহেব’, ‘এগারো’-র মতো ছবি হয়েছে টলিউডে। এ বার আসছে ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’।
|
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
|
|
|
|
|