দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দুপুরে দলবেঁধে অঞ্জলি দেওয়ার পর মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখা, একসময়ে রীতি ছিল ওঁদের। পুজো মানে ওঁদের কাছে এখন শুধু অতীতের স্মৃতি। ওঁরা প্রত্যেকেই রায়গঞ্জের দ্য ওয়েস্ট দিনাজপুর স্পিনিং মিলের কর্মী। কাঁচামালের সরবরাহের অভাবে গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের অধীনস্থ ওই মিলের উৎপাদন বন্ধ। সেই থেকে কর্মীদের বেতনও অনিয়মিত। কর্মরত অবস্থায় মৃতদের কর্মীদের পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরাও আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। প্রতিদিন কাজের সময়ে মিল চত্বরে বসে অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আইএনটিইউসি অনুমোদিত স্পিনিং মিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিল সরকার জানান, রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন হলেও মিলের কর্মীরা নিজেদের একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন। কারও আপদ-বিপদ হলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর কথায়য়, “একসময় সারাবছর একসঙ্গে কাটানোর পর দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দুপুরে মিলের কর্মীরা একসঙ্গে অঞ্জলি দেওয়ার পর মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখতাম। এখন শুধু স্মৃতি।” একইভাবে সিটু অনুমোদিত স্পিনিং মিল ওয়ার্কার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণচন্দ্র দেব জানান, গত দুই বছর ধরে মিলের কর্মীরা ২-৩ মাস অন্তর বেতন পাচ্ছেন। ওই সময়ের মধ্যে কর্মরত অবস্থায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৯ জন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু মৃতদের পরিবার ও অবসরপ্রাপ্তরা এখনও পেনশন ও অন্য আর্থিক সুবিধা পাননি। আগামী এক বছরের মধ্যে আরও ২০ জনের অবসর নেওয়ার কথা। |
ইতিমধ্যে ডান-বাম দুটি কর্মী সংগঠনের তরফে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছে মিলের উৎপাদন চালুর আর্জি জানানো হয়েছে। তাতেও কিছুই হয়নি। কর্মীদের একাংশের আশঙ্কা, রাজ্য সরকার মিলটি তুলে দিয়ে বেতন ও অবসরকালীন সুবিধা বন্ধ করে দিতে পারে।
মিল সূত্রের খবর, মিলে বর্তমানে ৫১৪ জন স্থায়ী ও ১৭৯ জন অস্থায়ী কর্মী রয়েছেন। সেখানে তুলো থেকে সুতো উৎপাদন হত। টানা আর্থিক লোকসানের জেরে মিল কর্তৃপক্ষ তুলো সরবরাহকারী দুটি সংস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে তুলোর দাম বাবদ বকেয়া ৮ কোটি টাকা মেটাতে পারেননি। ২০১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ওই দুই সংস্থা মিলে তুলো সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ২০১১ সালের জুলাই মাস থেকে তুলোর অভাবে মিলে সুতো তৈরির কাজ বন্ধ। উৎপাদন স্বাভাবিক থাকাকালীন প্রতিদিন ওই মিলে গড়ে ৭ হাজার কেজি সুতো উৎপাদন হত। রাজ্য সরকারের গাফিলতিতেই মিলটি রুগ্ন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। গত ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে মিলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেন রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত। বর্তমানে ওই পদে রয়েছেন চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমান। হামিদুলবাবু বলেন, “গত তিন দশকের সরকারি পরিকল্পনার অভাবের জেরেই মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে রাজ্য সরকার দ্রুত মিলটি চালুর চেষ্টা করছে।” আর মিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর তথা রাজ্য রেশম দফতরের অধিকর্তা বিজয়কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “মিলের উৎপাদন চালুর ব্যাপারে সরকারি কোনও পরিকল্পনা বা উদ্যোগের কথা জানি না।”
মিলের কর্মী মলীন সিংহ, প্রকাশ দে, সুনীল সরকার, সুবীর পালরা জানান, রাজ্য সরকার কতদিন বসিয়ে বেতন দেবে তা ভেবে আমরা আতঙ্কে রয়েছি। সেপ্টেম্বর মাসের বেতন আমরা পাইনি। বেতন বন্ধ হয়ে গেলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে। এ বছর আমাদের কাছে পুজোর তাই কোনও মানেই নেই। |