ধুপধাপ করে দু’চারটে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠে আসছিল দাদাভাই। জেঠুর রাতের খাওয়া সবে শেষ হয়ে এসেছিল তখন। পায়ের শব্দ শুনে ছেলের আগমনী বার্তা মালুম হল তার। বড়মাকে শুনিয়ে তাকে বলতে শোনা গেল, ‘ওই আসছেন বাড়ির রাজপুত্তুর। পুজোর মিটিংফিটিং, কত রাজকাজ। এই তোদের আশকারা পেয়েই ওর এতটা বাড় বাড়ছে।’ শেষের কথাটা বাবাকে উদ্দেশ করে বলা, তিতাস বুঝতে পারে।
বরাবরের মতো অধৈর্য ডোর বেল বাজানো যার অভ্যেস, সে আজ চার তলায় নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজাটা হাট করে খোলা এবং ডাইনিংয়ে সবাইকে হাজির দেখে, রাত যে দশটা বেজে গিয়েছে, তাতেও খুব একটা বিচলিত না হয়ে, সোৎসাহে বলতে থাকে, ‘কাকামণি, এ বার কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর আনা হবে।’
কথা বলতে বলতে সোজা বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসে পড়ে। মা ইতিমধ্যে নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দিয়েছিল। দাদাভাই যেন জানত,
এ রকমই হবে।
মা রুটি-মাংস-স্যালাড সহ খাবারটা এগিয়ে দিতেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে দীপু ওরফে দীপ্যমান, ক্লাস টুয়েলভ, কমার্সের ছাত্রটি— ‘ওহ্, মাংস! ফাসক্লাস।’ তার পর আধখানা রুটিতে মাংসের ঝোল মাখিয়ে গোগ্রাসে মুখে দিতেই অবধারিত কাশির বেদম ঝটকায় অস্থির হয়ে ওঠে। তখন বড়মা সটান কিচেন থেকে এসে দাদাভাইয়ের কানটা মুলে দিয়ে, জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘তুই কি এক রকমই থেকে যাবি চিরটা কাল? বড় হবি না? পইপই করে বলি, ধীরে-সুস্থে খা।’
‘বড় তো হচ্ছেই। আকারে প্রকারে। নিরেট মগজ। আকাট মূর্খই থেকে যাবে চিরটা কাল। কে বলবে এইচ এস দেবে।’ জেঠু নিজের ঘরে খেতে খেতে বলে।
তিতাসের খুব কষ্ট হয়। বড়রা এ রকম ভাবে কেন কথা বলে? এ সব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাবা। মন দিয়ে, মুখ নিচু করে তখন খাচ্ছিল দাদাভাই। বাবা চেয়ারটা টেনে পাশে বসে। দাদাভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘ছাড় ওদের কথা। আমি জানি আমাদের দীপ্যমান ফাটাফাটি রেজাল্ট করবে। আর তার জন্য একটু-আধটু মন দিয়ে পড়াশোনা করতে তো হবেই। এই পুজো মিটে গেলেই কিন্তু আমি হাল ধরব তোমার,’ বাবা ইশারায় বড়মা আর মাকে খেতে বসতে বলে। ‘তো? কুমোরটুলি থেকে মা দুগ্গা আসছেন এ বার হাউজিং-এ। কিন্তু সে তো বিশাল বাজেট রে?’
মনের মতো প্রসঙ্গ পেয়ে দীপু তখন গরগর করে বলে যেতে থাকে, ‘জানোই তো অভিদা চাকরি পেয়েছে টিসিএস-এ। আর অপুদার কেটারিং ব্যবসা নাকি ফাটাফাটি চলছে। ওরা দু’জন প্রতিমা স্পনসর করবে। কালই অর্ডার দেওয়া হবে। আর জয়দার বউ মলিবউদি স্কুলে জয়েন করেছে। লাইটিংটা পুরো ওদের খরচা। এ ছাড়া ক্লাবের দাদারা, যারা চাকরি করে, তারা এ বার পুজোয় চার দিন খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। আর আবাসিকদের চাঁদা দিয়ে পুজোর বাদবাকি খরচ মেটানো হবে।’ |
‘বাহ্, এই না হলে আমার ভাইপো! দেখো তো, কী সুন্দর জলবৎ তরলং হয়ে গেল পুরো ব্যাপারটা! শুধু লেখাপড়াটাতেই যা একটু বেগড়বাই করে...’ ‘ভাল হবে না কাকামণি। আমি প্রমিস করছি, দেখে নিয়ো রেজাল্ট।’ ‘আমি জানি তো’ বাবা দাদাভাইয়ের চুলটা ঘেঁটে দিয়ে উঠে পড়ে। ‘আরে, বাকিটা শুনবে না?’ ‘আরও আছে? নে শেষ কর। কাল আর অফিস যাওয়া হবে না দেখছি’। হাই তুলছিল বাবা।
বড় মা রেগে গিয়ে বলে, ‘তুমি যাও তো শুতে। ও সব পাগলের প্রলাপ পরে শুনলেও হবে।’ ‘না বউদি। দীপ্যমান পাগলের প্রলাপ বকে না’— গ্যাঁট হয়ে চেয়ারে বসে সিগারেট ধরায় বাবা। ‘ভাইয়াদের নিয়ে এ বার অপুদা ‘ডাকঘর’ করাবে। আমি সাফ বলেছি, অমলের পার্টটা ভাইয়াকে দিতে হবে। ক্লাবের সবাই মেনে নিয়েছে। আর, অপুদা তো স্ট্রেট বলেই দিল, তিতুর মতো আবৃত্তি ক’টা ছেলেই বা করতে পারে?’
তিতু, ওরফে তিতাস তখন একটু লজ্জা পেল।
দাদাভাইয়ের খাওয়া শেষ। বেসিনে মুখ ধুচ্ছিল।
মা আর বড়মা খেতে বসেছিল। ‘দেখো, তখন থেকে গল্প গিলছে। আর পড়তে বসলেই চোখে রাজ্যের ঘুম।’
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই বড়মায়ের গলা, ‘আর কী, নিজের তো বারোটা বেজেই গেছে। এ বার ভাইটাকেও দলে টানো।’
সিগারেটের শেষটুকু অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বাবা বলে, ‘এ সব তোমাদের ভুল ধারণা। ক্লাব-নাটক করলে কেউ বখে যায় না। বরং একটা ইউনিটি বোধ আসে।
ফেলো-ফিলিং তৈরি হয়। আর, অপু পাড়ার ছেলেদের নিয়ে যে স্ট্যান্ডার্ডের নাটক করায়, তা কলকাতার বহু নামীদামি দলের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে।’
কত বার যে ‘ডাকঘর’ নাটকটা পড়েছে তিতাস, ও নিজেই জানে না। তবু, অমলের যে ঠিক কী অসুখ,
ও বুঝতে পারে না। কাউকে জিজ্ঞাসাও করেনি। কিন্তু, এক চিলতে জানলার ধারে বসে পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গে গল্প করা, কল্পনায় বহু দূরে চলে যাওয়া অমলকে ওর ভীষণ ভাল লাগে।
দাদাভাই পাশে শুয়ে তখন ঘুমিয়ে কাদা।
কোনও স্টেজ হয়নি নাটকটার জন্য। হাউজিংয়ের ছোট্ট মাঠটাকে দারুণ ব্যবহার করেছে অপুদা। চৌকির ওপর একটা ঘরের আভাস। এক টুকরো জানলার ফ্রেম। মাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আম, জাম, ইউক্যালিপটাস গাছগুলো আলো-আঁধারিতে দারুণ ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে সেজে উঠেছিল। দর্শকরা বসেছিল মাঠের চারিদিকে।
দইওয়ালা সেজেছে টুকাই। হাঁটুর ওপরে খাটো ধুতি পরনে ওর। কাঁধে বাঁকে ছোট্ট দুটো মাটির হাঁড়ি।
ও অসাধারণ অভিনয়ে মাত করে দিল দর্শকদের।
ছেলের দল হল্লা করে স্টেজে ঢুকল। পাপাই, ঋজু, বুড়ো, তাতুন— সবাই। ‘দারুণ দারুণ’ বলে দর্শকরা হাততালি দিল।
সুধার পায়ের মল বেজে উঠল। খিল খিল করে হাসতে হাসতে মঞ্চের দিকে দৌড়ে এল তিন্নি। হাতে ফুলের সাজি। পাড়ার মেয়ে এবং একই ক্লাসে পড়লেও তিতুর সঙ্গে একদম বনিবনা নেই তিন্নির। ভীষণ ঝগড়ুটে। নিজের পার্টটুকু মুখস্থ বলে গেল। যেন মঞ্চে অমল নেই। রাগ হলেও জুতসই অভিনয়ে তিতাস ফাটিয়ে দিল।
চারিদিকে তখন হাততালির ঝড়।
নাটক শেষে সুদর্শনকাকু মঞ্চে এলেন। ঘোষণা করলেন, তিতাসের অভিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ। ওকে তিনি পুরস্কৃত করতে চান। আবার হাততালির ঝড় উঠল।
হঠাৎ কান্নার আওয়াজে সবাই অবাক হয়ে দেখল, তিন্নি ওরফে সুধা কাঁদছে। আর বলছে, ‘কেন শুধু তিতাস একা প্রাইজ পাবে? আমরা বুঝি খাটিনি নাটকটার জন্য?’
সব্বাই হো হো করে হাসছিল তখন। কেউ কেউ তিন্নিকে সামলাচ্ছিল। ক্লাবের দাদারা তখন মুশকিল আসান হিসেবে হাজির হল। রাজাদা ঘোষণা করল, ‘ঠিক আছে। এই সুন্দর নাটকটার জন্য যারা অভিনয় করেছ, সব্বাইকে প্রাইজ দেওয়া হবে কালীপুজোর রাতে।’
দর্শকরা আনন্দে আবার হাততালি দিল। ঠিক তখনই তিন্নি তিতাসের কাছে এসে ভেংচি কেটে বলল, ‘ঠিক হয়েছে। ইস্, উনি একাই শুধু হিরো হবেন। শখ কত!’
তিতাসের মতো শান্ত ছেলেও রেগে চিৎকার করে উঠল, ‘পাজি, হিংসুটে।’ ‘আরে, এই ভাইয়া, কে পাজি, হিংসুটে? আচ্ছা কেলো তো? নে ওঠ। জল খা। চোখে মুখে জল দে।’ আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল দাদাভাই। ঘড়িতে তখন রাত দুটো।
ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে নেয় তিতাস। তার পর শুয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে, এই স্বপ্নের ‘ডাকঘর’ যদি সত্যিই মঞ্চস্থ হয়, সুধার রোলটা কি তিন্নিই করবে? তিতাস তখনই ঠিক করে নিল, তিন্নির সঙ্গে ভাব করে নিতে হবে। পুজোর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মন কষাকষি করে কী লাভ? সবাই মিলেমিশে থাকাই ভাল। |