|
|
|
|
পুজো তর্পণে দুই মেদিনীপুরে প্রকাশ শতাধিক শারদ সংখ্যার |
অমিত কর মহাপাত্র • হলদিয়া |
দুর্গাপুজোয় বাঙালি সংস্কৃতির অনন্য অঙ্গ ‘শারদীয় পত্রিকা’। বলা হয়, এটি সাহিত্যরসিক বাঙালির এক রকমের মাতৃ আরাধনাও। এক কথায় কবি, সাহিত্যিক পাঠকের কাছে ‘শারদীয় পত্রিকা’ যেন ‘পুজো-পুরাণ’।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে সাহিত্যে পুজোসংখ্যা প্রকাশের চল শুরু হয়। তা ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতি আত্তীকরণ করে। মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক শহুরে সেই সংস্কৃতির শেকড় সঞ্চারিত হয় জেলায় জেলায়। এই স্রোতে ব্যতিক্রম নয়দুই মেদিনীপুরও।
দুই মেদিনীপুরের সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকাগুলির সম্পাদকরা বিশ্বাস করেন শারদীয় পত্রিকার হাত ধরেই জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি অন্য মাত্রা পেয়েছে। মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন অ্যাকাডেমির সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী জানান, “দুই জেলায় তিনশোরও বেশি সাহিত্য পত্রিকা থাকলেও শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করেন প্রায় একশো সম্পাদক। সাধারণ ভাবে চার দশক আগে থেকে পত্রিকাগুলির যাত্রা শুরু।” তাঁর মতে, “লিটল ম্যাগাজিনের পুজোসংখ্যাগুলি প্রথম দিকে ছিল পাঁচমেশালি। বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিকে কিছুটা হলেও অনুকরণের প্রয়াস থাকত। সে তুলনায় সাম্প্রতিক পত্রিকাগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য আবেগের সংযম ও বুদ্ধি-নির্ভরতা। এ বারের পুজোয় অনেকগুলি সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা হয়েছে।’’ |
|
মেদিনীপুরে ‘অমিত্রাক্ষরে’র ছদ্মবেশ সংখ্যার প্রকাশ। ছবি: কিংশুক আইচ। |
পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদা থেকে অণুগল্পের পত্রিকা ‘অনুরণন’ প্রকাশ করেন অসিতবরণ বেরা। তাঁর মতে, “একেকটি পত্রিকার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এক এক রকম। তাই একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টাও থাকে।” মূলত সম্ভাবনাময় কবিদের নিয়ে পুজো সংখ্যা সাজিয়েছেন ঘাটালের ‘মহুল’ পত্রিকার সম্পাদক কেশব মেট্যা। তাঁর বক্তব্য, “এই পত্রিকাগুলির সঙ্গে তথাকথিত বাণিজ্যিক পত্রিকার অনেক পার্থক্য। আমাদের চেষ্টা থাকে পুজোর পরও যাতে সংখ্যাটির আকর্ষণ বজায় রাখা যায়।” তমলুক থেকে প্রকাশিত ‘শব্দপথ’ পত্রিকার সম্পাদক প্রদীপ্ত খাটুয়া তাঁর পুজো সংখ্যায় রামকিঙ্কর বেজকে নিয়ে বিশেষ নিবন্ধের পাশাপাশি কবিতা বিষয়ক নানা প্রবন্ধ, গল্প দিয়ে সংখ্যা সাজিয়েছেন।
সাধারণত মহালয়ার কয়েক’দিন আগে থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত পত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠান চলে। এখন পত্রিকায় শুধুমাত্র বিষয়ের চমক বা নতুনত্ব নয়, পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান ও বিপণনের ক্ষেত্রেও চমক আনছেন সম্পাদকরা। কোথাও ‘পুজোর লিটল ম্যগাজিন’ তাঁবু বানিয়ে, কোথাও কবি-লেখক সম্মেলন করে চলছে পত্রিকা প্রকাশ। মেদিনীপুরের ‘অমিত্রাক্ষর’ পত্রিকার সম্পাদক অচিন্ত্য মারিক পুজো সংখ্যা করেছেন ছদ্মবেশ বিষয়ে নানা গবেষণামূলক প্রবন্ধ দিয়ে। শুক্রবার উদ্বোধনে হাজির সকলেই পড়েছিলেন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের মুখোশ। নানা ধরনের ছদ্মবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে মোট ২২ জন লেখক এই সংখ্যার জন্য কলম ধরেছেন। প্রাচীনকালের ছদ্মবেশ থেকে হাল আমলের ছদ্মবেশ, তার নানা ব্যবহার, সুফল-কুফল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সম্পাদকের কথায়, “চর্বিত চর্বণ নয়, আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষিত পাঠক সমাজের কাছে বৈচিত্র্য আনতে।” ঘাটালের ‘সৃজন’ পত্রিকার সম্পাদক লক্ষ্মণ কর্মকার আবার সব শ্রেণির পাঠকদের জন্য সাজান তাঁর পুজো সংখ্যা। এ বার করেছেন ছ’শো পাতার পত্রিকা। মহিষাদল থেকে প্রকাশিত ‘প্রেক্ষাপট’ সংবাদপত্রের সম্পাদক সুব্রত চক্রবর্তীর পুজো সংখ্যা সংস্কৃত সাহিত্য নির্ভর হয়ে ভিড়ের মধ্যে আলাদা হয়েছে। তিনি বলেন, “দুই বাংলার লিখিয়েদের স্থান দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশের নানা লেখাও স্থান পায় আমাদের সংখ্যায়। থাকে অনুবাদ সাহিত্য।”
পত্রিকার প্রচ্ছদগুলিও আকর্ষণীয়। কোথাও আছে শরতের আবহে দুর্গার আবাহনী, কোথাও আছে লোক আঙ্গিকে নানা রূপের দুর্গা, আবার কোথাও শরতের নানা রঙের কোলাজ। পিছিয়ে নেই ছোটদের পত্রিকাও। হলদিয়া থেকে ৩৪ বছর ধরে শারদীয় সংখ্যা করছেন ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকার সম্পাদক মধুসূদন ঘাটী। রয়েছেন শৈলেন ঘোষ, প্রচেত গুপ্ত, রতনতনু ঘাটীদের মতো সাহিত্যিকের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী নির্মলেন্দু মণ্ডল, অনুপ রায়দের লেখাও। মেদিনীপুর থেকে ২৯ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে ছোটদের পত্রিকা ‘নয়ন’। নয়নের সম্পাদক বিদ্যুৎ পাল তাঁর শারদীয় সংখ্যা সাজিয়েছেন দেড়শো জনের ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, খেলাধুলা ও চুটকি দিয়ে। তিনি আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন মেয়েদের লেখাকে।
পুজোর আনন্দে ভাসছে চরাচর। প্রকৃতিও সেজেছে তার লাবণ্যময় উপাচার নিয়ে। আর পত্রিকার শারদ সংখ্যাগুলি যেন এক এক করে ফুটে উঠছে শিউলি, শালুক পদ্ম হয়ে। |
|
|
|
|
|