গলায় তুলসির মালা, কোটরে ঢুকে যাওয়া উজ্জ্বল দু’টি চোখ। বয়সের ভারে কোমর বেঁকে যাওয়ায় সোজা হয়ে ভাল ভাবে দাঁড়াতেও পারেন না। এলাকায় তিনি পরিচিত ‘চা-মাসি’ নামে। রয়েছে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সেই দোকান চালান তিনি। ছেলে চালায় ভ্যানরিকশা।
দেশভাগের পর হাসিরানি চলে এসেছিলেন বনগাঁর নিউমার্কেট এলাকায়। এখন স্থায়ী ঠিকানা দীনবন্ধুনগর বটতলায়। চায়ের দোকান বনগাঁ স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায়। জীবনযাত্রা অন্য পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই। তবু স্মৃতির সরণিতে মাঝে মাঝে আলাদা হয়ে যান অন্যদের থেকে। গাঁধীজির ছবি দেখলে বা কথা শুনলেই পুরনো সময়ে ফিরে যান ৭৫ বছরের বৃদ্ধা হাসিরানি বসু। সময়-সুযোগ পেলেই গল্প করেন দোকানে চা খেতে আসা মানুষজনের সঙ্গে। বলেন পুরনো দিনের কথা।
কি সেই কথা? |
বৃদ্ধা বলতে শুরু করেন গাঁধীজিকে প্রথম ও শেষবার সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতার কথা। বয়স তখন তাঁর মেরেকেটে ১০-১২। বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার বেলেখামার গ্রামে। সালটা ছিল সম্ভবত ১৯৪৬। গোটা গ্রাম ঢলে পড়েছিল খুলনার লীলা সিনেমাহল সংলগ্ন মাঠে। গিয়েছিলেন গাঁধীজিকে দেখতে, তাঁর বক্তৃতা শুনতে। বড়দের কাছে গল্প শুনেই আগ্রহ জন্মেছিল। সকাল সকাল গ্রামে রান্না হয়ে গিয়েছিল সকলের বাড়িতে। খাওয়া সেরে প্রায় দু’ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছেছিলেন সভাস্থলে। গোটা মাঠে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। মঞ্চ থেকে কিছুটা দূরেই বসেছিলেন তিনি। গাঁধীজি এলেন, বক্তৃতা দিলেন। সে দিন প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন জাতির জনক। হিন্দিতেই বলেছিলেন। ফলে সবটা বুঝতে পারেনি সে দিনের সেই বালিকা। তবে তাঁর মনে আছে, যখন গাঁধীজি বলেছিলেন ‘বন্দেমাতরম’। গোটা মাঠ ধ্বনি তুলেছিল, ‘বন্দেমাতরম’। যা শুনে বালিকার শিহরণ আজও মনে পড়ে হাসিরানির।
তবে সে দিন একই সঙ্গে তাঁর একটি বড় আক্ষেপও তৈরি হয়েছিল। খুব ইচ্ছে ছিল গাঁধীজিকে একবার ছঁুয়ে দেখার। তার বন্ধুদের অনেকেরই সে সুযোগ হয়েছিল। হাসিরানির সুযোগ হয়নি।
কিন্তু এত বছর পরেও সেই আক্ষেপ যায়নি বৃদ্ধার। এখনও চোখ বুজলেই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে গাঁধীজির খাটো খদ্দরের ধুতি, চশমা চোখে লাঠি হাতে চেহারা। কাঁধের উপরে ভাঁজ করে ফেলা খদ্দরের চাদর। মাথায় টুপি।
গাঁধীজি মারা যাওয়ার পরে লোকমুখে সে খবর শুনে কয়েক রাত ঘুমোতে পারেননি হাসিরানি। পরবর্তীকালে দেখেছেন মুজিবর রহমান ও ইন্দিরা গাঁধীকেও। গাঁধীজির জন্মদিনের কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি। ফের স্টোভ জ্বালিয়ে শুরু করলেন চা তৈরি। তাঁর কথায়, “যখনই কেউ বড় নোট দেন আর তাতে দেখি গাঁধীজির ছবি, ফিরে যাই সেই ছোট্টবেলায়।” |