নগরায়ণের জেরে ছায়া হারাচ্ছে কলকাতা
বার্ধক্যের ছায়া পড়েছে শহরে!
কবেকার সব গাছগাছালি।
তাদের মাথা উজিয়ে জেগেছে বহুতলের জঙ্গল।
নগরায়ণের ধুমে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা কংক্রিটের ভিড় ঠেলে শহরের অপরিসর পথ-ঘাট। কলকাতার যেটুকু সবুজ, তা ওই পথের দু-পাশে, বার্ধক্যের ছায়া ফেলে দিন গুনছে।
সে ছায়াও গুটিয়ে এল বলে। কেন? বয়সের ভারে ন্যুব্জ, প্রায় ভঙ্গুর সেই বৃক্ষকুলের ভিত নড়িয়ে দিতে বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, সামান্য মরসুমি ঝড়ই যে যথেষ্ট।
দেশের সাতটি মহানগরের বাড়-বৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং তার সৌন্দর্যায়নের বিবরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে কলকাতার গাছগাছালি নিয়ে রয়েছে এমনই বক্রোক্তি।
উদ্বেগটা অমূলক নয়। গত এক বছরে, নিছক শেষ চৈত্রের কালবৈশাখী, বর্ষার ঝড় বৃষ্টি কিংবা শরতের দমকা হাওয়ায় শহর জুড়ে প্রায় দু-হাজার বৃক্ষ-পতনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সৌজন্য, রাজ্যের বন ও পূর্ত দফতরের হিসেব।
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারের বাড়তি সংযোজন, “গত পয়লা এপ্রিল থেকে সামান্য ঝড়-জলে কলকাতার রাস্তায় অন্তত হিসেব মতো ৯৫টি গাছ পড়ে গিয়েছে।” হিসেবের বাইরে? পুরসভার একটা সূত্র বলছে, সংখ্যাটা অন্তত শ-দুয়েক। বিধাননগর পুরসভার পরিসংখ্যান বলছে, গত ছ’মাসে ঝড়ে পড়া গাছের সংখ্যা অন্তত দেড়শো।
উপড়ে গিয়েছে এক মহীরূহ। বুধবার, শহরের রাস্তায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
এবং সমস্যার কথা, এই বয়স্ক বৃক্ষরাজির পতন ঠেকানোর আশু কোনও ‘দাওয়াই’ জানা নেই বৃক্ষ-বিশেষজ্ঞদের। তবে ‘রোগের’ একটা কারণ বাতলেছেন তাঁরা, খাদ্য সঙ্কট। তাঁদের মতে, অশক্ত মহীরূহদের ভিড় আর প্রবল নগরোন্নয়নের ধাক্কায় তৈরি হওয়া খাদ্য সঙ্কটে কলকাতার গাছগাছালির এমন দুর্বল-দশা।
দিল্লির একটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠন, দেশের বেশ কয়েকটি মহানগরের গাছগাছালির হালহকিকতের খোঁজ করে জানিয়েছে, শহর কলকাতার প্রায় ২০ শতাংশ গাছের বয়স দেড়শো বছর বা তার বেশি। অন্তত ২৭ শতাংশ গাছই শতবর্ষ পার করেছে। অর্থাত্‌, এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, কলকাতায় প্রায় সংখ্যগরিষ্ঠ গাছই প্রাচীন। বয়সের ভারে তারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওই সংগঠনের পক্ষে অঙ্কিতা সাকসেনা বলেন, “এত পুরনো শহর, এখানকার অধিকাংশ গাছ যে পুরনো তা সমীক্ষার আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। কিন্তু, যা ভাবিনি, তা হল কলকাতার গাছেরা এমন খাদ্য সঙ্কটে ভুগতে পারে।”
পুরনো শহরে প্রাচীন গাছ থাকবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু খাদ্য সঙ্কট কেন?
ওই সংগঠনের দাবি, গত তিন দশকে শহরে প্রচুর নতুন গাছ লাগানো হলেও তাদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। নগরায়ণের চাপে মাটি থেকে তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যও পাচ্ছে না। ইট-সিমেন্টের দাপটে শহরের মাটি তার চরিত্রই বদলে ফেলেছে বলে মনে করছেন অঙ্কিতা। শান বাঁধানো ফুটপাথ, অ্যাসফাল্টের রাস্তা, কংক্রিটের প্রশস্ত পরিসর ভেদ করে শহরের গাছাগাছালি তার শেকড়ের বিস্তারই ঘটাতে পারছে না।
বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ সমর বসু বলছেন, “সল্টলেক বা নিউ টাউনের মতো পরিকল্পিত উপনগরীতে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই খেয়াল করছি না যে, ইট-সিমেন্টের আধিক্যে শহুরে মাটিতে গাছ তার শিকড়ের বিস্তার ঘটাতেই পারছে না। মাটির ফুট দশেক নীচেই সিমেন্টের এমন আস্তরণ পড়ে গিয়েছে যে শিকড় চালাতে পারছে না গাছ।” ফলে খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে তারা। শহরের পুরনো পথঘাটের ক্ষেত্রেও কথাটা খেটে যায়। সেখানে নব্য ইমারত উঠেছে। সে মাটিতেও এখন সিমেন্ট, বালি, চুন-সুরকির আধিক্য। গাছ খাবার পাবে কি করে?
খাদ্যাভাবে দুর্বল সেই সব গাছগাছালি সামান্য ঝড়েই তাই মুখ থুবড়ে পড়ছে।
নগরায়ণের ধাক্কায় দেখা দিয়েছে আরও এক সমস্যা।
পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগের প্রধান তথা পরিবেশ-বিজ্ঞানী স্বদেশরঞ্জন মিশ্র জানান, খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি বহুতলের ভিড়ও শহরে বৃক্ষ-পতনের একটা বড় কারণ। তাঁর ব্যাখ্যা, “কলকাতার রাস্তার দুধারে গাছগাছালির চেয়েও কংক্রিটের জঙ্গলের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে। কালবৈশাখী কিংবা বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে ঝোড়ো বাতাস বহুতলে ধাক্কা খেয়ে ওই রাস্তা বরাবর ছুটতে থাকে। হাওয়ার গতিও সে সময়ে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সেই সময়ে ওই সব রাস্তায় যে ‘টানেল এফেক্ট’ তৈরি হয় তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ওই অপুষ্ট, বয়স্ক গাছগাছলির নেই। তাই তারা সমূলে পড়ে যায়।”
তা হলে উপায়?
ছায়ায় ছায়ায় তারই উত্তর হাতড়াচ্ছে শহর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.