মাঠের ভিতরে একটি ছাউনি। তাতে খুপরি কাটা কাগজের বোর্ড টাঙানো। কয়েকটি খুপরিতে লাল দাগ। কয়েকটিতে সবুজ। শেষের চারটিতে লাল দাগ।
ওই কাগজের বোর্ডটা আসলে ক্যালেন্ডার। পুজোর কাজ কতটা এগোলো, তা সবুজ আর লাল চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। সবুজ, অর্থাৎ যে কাজ ওই দিনের জন্য নির্দিষ্ট, তা শেষ হয়েছে। আর লালের অর্থ, কাজের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো যায়নি। শনিবার থেকে দক্ষিণ কলকাতার ওই মণ্ডপে বাইরের কাজে হাত দেওয়ার কথা ছিল। বৃষ্টির জন্য শুরু করা যায়নি। রবি, সোম ও মঙ্গলবারেও কাজ বন্ধ।
মাঠের থকথকে কাদায় এখানে ওখানে ছড়িয়ে কাঠ ও বাঁশ। তার মধ্য দিয়েই মণ্ডপে ঢোকানো হয়েছে প্রতিমা। এক উদ্যোক্তার কথায়, “কুমোরটুলিতে প্রতিমা রাখার ঝুঁকিটা আর নিতে পারছিলাম না। ওখানে প্রতিমা শুকোচ্ছিলই না। মণ্ডপের মধ্যে পাঁচ-ছ’টা ফ্যান লাগিয়ে দিয়েছি। দিব্যি রং শুকোচ্ছে।” মণ্ডপের ভিতরে অঙ্গসজ্জা শেষ। বাইরের কাজ পুরোটাই বাকি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে উদ্যোক্তা, মণ্ডপশিল্পী, শ্রমিক সকলেই। |
প্রতিমা বাঁচানোর তোড়জোড়। মঙ্গলবার কুমোরটুলিতে। ছবি: সুমন বল্লভ। |
পুজোর এক উদ্যোক্তার হতাশ মন্তব্য, “মহালয়ার আগেই কাজ শেষ করার লক্ষ্যে এগোচ্ছিলাম আমরা। চতুর্থীর দিন উদ্বোধন। বৃষ্টিটাই আমাদের পিছিয়ে দিল। শুধু যে কাজ বন্ধ তা-ই নয়, প্রায় ৩০ জন শ্রমিককে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দিতে হচ্ছে। ওঁদের মহালয়ার দিন ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও ঠিক ছিল। সেটাও হবে না। আরও কয়েক দিন রাখতে হবে ওঁদের। দৈনিক মজুরি তো আছেই। সঙ্গে খাওয়া-থাকার খরচ। খুব মুশকিল হয়ে গেল আমাদের।”
জুন থেকেই এ বার অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে কলকাতায়। তাই পুজোর আগে বৃষ্টির দম ফুরিয়ে যাবে বলেই ধরে নিয়েছিলেন উদ্যোক্তা এবং মণ্ডপশিল্পীরা। সেই মতো তাঁরা মণ্ডপের ভিতর-বাইরের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতি তাঁদের বোকা বানিয়ে দিয়েছে।
উত্তর শহরতলির দমদম পার্ক এলাকার একটি মণ্ডপের কাজ শেষ। সেই মণ্ডপের উপরে ঢাকা দেওয়া ত্রিপল আর প্লাস্টিকের ছাউনি খুললেই শিল্পী বুঝবেন তিনি যা চেয়েছিলেন, সেটাই হয়েছে কি না। তার পরে ছোটখাটো পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু ছাউনি খোলাই যাচ্ছে না যে! শিল্পীর আক্ষেপ, “আমার কাজ শেষ। কিন্তু কাজটা কেমন হল, তা বুঝতেই পারছি না। বাইরেটা না খুললে আলোকসজ্জার কাজটা শুরুই করা যাচ্ছে না। জুতসই আলো না হলে আমার এই মণ্ডপ জমবেই না।”
পিছিয়ে রয়েছে কুমোরটুলিও। এ বার গোটা বর্ষা বৃষ্টি ভুগিয়েছে। তাই প্রথম থেকেই অনেক কাজ বাকি পড়ে। প্রতিমার গায়ে মাটি দেওয়া থেকে শুরু করে রং করা, সব কাজই থমকে গিয়েছে। এ বার ২২টি প্রতিমা গড়ছেন শিল্পী নব পাল। বেশির ভাগেরই কাজ ইতিমধ্যে শেষ। কিন্তু রং যে শুকোচ্ছে না! বরাত দেওয়ার সময়েই নব ক্লাবকে প্রতিমা দেওয়ার দিন বলে দেন। সেই তারিখের যাতে নড়চড় না হয়, সেটাও খেয়াল রাখেন। নব বলেন, “এ বার জুন, জুলাই, অগস্টের বৃষ্টির মধ্যেও কাজ ভালই এগোচ্ছিল। কিন্তু ঘাটে এসে শেষ পর্যন্ত তরী ডোবাচ্ছে বৃষ্টিটাই। নির্দিষ্ট দিনেই যে প্রতিমা দিতে পারব, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।”
নবর আক্ষেপ, “ফ্যান, ব্লোয়ার চালিয়েও প্রতিমায় চাপানো রং শুকোনো যাচ্ছে না। সমস্যাটা সেখানেই।” নবর সমসাময়িক তরুণ শিল্পী পরিমল পাল কিন্তু তাঁর গড়া প্রতিমার অধিকাংশই পাঠিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন মণ্ডপে। পরিমল বলেন, “মণ্ডপে গিয়েই প্রতিমায় তুলির শেষ টান দেব।” তবে কুমোরটুলির যে সব ঘর থেকে প্রতিমা এখনও মণ্ডপে যায়নি, তাঁদের সমস্যাটা খুবই প্রকট। পুজোর উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট দিনে আসছেন, কিন্তু বৃষ্টি দেখে ফিরে যাচ্ছেন। কুমোরটুলির এক শিল্পীর সহযোগী উত্তম পালের কথায়, “ঘরে প্রতিমা রাখা আরও ঝামেলার। প্লাস্টিকের খরচ আছে। ফ্যান, ব্লোয়ার চালানোর খরচ আছে। আমরা ক্লাবগুলিকে আগেভাগে প্রতিমা নিয়ে যেতে বলেছিলাম। ওরা নিচ্ছে না।”
মহালয়া আর দু’দিন পরেই। এই সময়টায় পুজোর বাজার থাকে তুঙ্গে। শনি-রবিবারের বৃষ্টি পুজোর বাজারের দফারফা করে ছেড়েছে। এ বার টার্গেট আজ, বুধবারের দিনটা। গাঁধী জয়ন্তীতে অফিসকাছারি, স্কুল-কলেজ সব ছুটি। বুধবারটা তাই হাতে রেখেছেন অনেকেই। দোকানিরাও আশায় রয়েছেন। গড়িয়াহাটের এক রেডিমেড পোশাক বিক্রেতা মানিক সাহা বলেন, “একটু আগে টিভিতে দেখলাম নিম্নচাপ নাকি সরে যাচ্ছে। আমার দোকানের সব কর্মচারীকে বুধবার তাড়াতাড়ি চলে আসতে বলেছি। পুজোর আগে এটাই শেষ সুযোগ।” |