ফলশ্রুতি শব্দটি বাংলায় ‘ফল’ অর্থে বহুলপ্রচলিত। উহা অশুদ্ধ ব্যবহার। শব্দটির প্রকৃত অর্থ ‘পুণ্যকর্মের ফল শ্রবণ অথবা তাহার বিবরণ’। পুণ্যকর্ম বলিতে এ ঘোর কলিতে কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান বুঝাইবে কেন? দুই প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীরা যদি মুখোমুখি বসিয়া বাক্যালাপ করেন, তাহা কম পুণ্যকর্ম নহে। বিশেষত সেই দুই প্রতিবেশীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি কণ্টকাকীর্ণ হয়, তবে তো পুণ্যের মাত্রা সমধিক। এমন একটি পুণ্যকর্মের ফল শুনাইবার জন্য মনমোহন সিংহ এবং নওয়াজ শরিফ যৌথ ভাবে সাংবাদিক বৈঠক করিলেন না, কোনও যুগ্ম বিবৃতিও প্রকাশ করিলেন না, দুই দেশের বিদেশ সচিবরা স্বতন্ত্র ভাবে ফলশ্রুতির ব্যবস্থা করিলেন, ইহা কি বিস্ময়কর? উত্তর: না। নিউ ইয়র্কে মনমোহন সিংহ ও নওয়াজ শরিফের এক ঘণ্টার বৈঠকের ফলশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ নহে, কারণ তাহার কোনও বড় ফলাফল নাই।
কিন্তু সেই কারণে এই বৈঠককে নিষ্ফল বলা যাইবে না। কোনও চমকপ্রদ বা গুরুত্বপূর্ণ ফলের আশায় এই বৈঠক হয় নাই। ইহা যে ঘটিয়াছে, তাহাই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চমকপ্রদও বটে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এই আলাপের আয়োজন হইয়াছিল। কিন্তু সীমান্তে উত্তেজক পরিস্থিতি, বিশেষত নিয়ন্ত্রণরেখায় গুলিবর্ষণে ভারতীয় জওয়ানদের মৃত্যু, পাক-আশ্রিত জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ও ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের ছাউনিতে হামলা শীর্ষ বৈঠককে অনিশ্চিত করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ভিতরেও উভয় নেতার সামনেই বিরোধী রাজনীতিকদের বাধা সেই অনিশ্চয়তা বাড়াইয়া দেয়। বিশেষত এই প্রতিকূল পরিবেশে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কেন পাক প্রধানমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে ব্যগ্র, দেশের বিরোধী দল সেই প্রশ্নও তোলে। এ সব কিছুই যে শেষাবধি বৈঠকের পথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় নাই, ইহা প্রাপ্তমনস্কতারই পরিচায়ক। কেহ কেহ বলিতেছেন, দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চালাইবার যে সিদ্ধান্ত এই বৈঠকে হইয়াছে, সেই মামুলি বিষয়ের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর একত্র বসার দরকার কী ছিল? দরকার ছিল। আলোচনার প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার ছিল। পাকিস্তানের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বে পালাবদলের পর ইহাই ছিল দুই প্রধানমন্ত্রীর প্রথম শীর্ষ বৈঠক। কূটনীতিতে আকস্মিক কোনও পালাবদল ঘটে না, ঘটিবার কারণ নাই।
পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নির্বাচনের আগেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতের সহিত সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়িয়া তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। ইহা যদি মুখের কথামাত্র হয়, তাহাও মূল্যবান। পাকিস্তানের পরিষদীয় রাজনীতির ইতিহাসে নির্বাচনী প্রচারে এমন অঙ্গীকার সুলভ নহে। নির্বাচনে শরিফের বিপুল জয় দেখাইয়া দেয়, তাঁহার ভারত-সংক্রান্ত নীতিতে পাক জনসাধারণের অনুমোদন আছে, অন্তত প্রবল আপত্তি নাই। তবু বাধা থাকিয়াই যায়। বাধা কেবল পাক সামরিক আমলাতন্ত্রের তরফে নয়, শাসক গোষ্ঠীর তরফেও, যাঁহারা নিয়ন্ত্রণ রেখায় নিজেদের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারেন না বা চাহেন না। তবু নওয়াজ শরিফ মনমোহন সিংহের সহিত বৈঠকের আগ্রহ হারান নাই। মনমোহন সিংহের বক্তব্য প্রথমাবধি স্পষ্ট: যত প্ররোচনাই আসুক, শান্তি-প্রক্রিয়া বন্ধ করা উচিত নয়, কেননা তাহার কোনও বিকল্প নাই। তিনি দেশের অভ্যন্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদের যাবতীয় উস্কানি অবহেলায় অগ্রাহ্য করিতে পারিয়াছেন। বিরোধী দলের ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী পদ-প্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর সম্পূর্ণ অহেতুক প্ররোচনামূলক মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিকই থাকিয়া গিয়াছে। এমন মন্তব্য অবশ্যই অনভিপ্রেত, কিন্তু ভোটের বাজারে অধুনা এই সকল কুভাষিতেরই জয়জয়কার। |