পুজো একই রয়েছে, বদলেছে পুজো প্রাঙ্গণ
প্রায় আড়াই দশক আগের কথা। পদ্মার পাড় লাগোয়া বানভাসি গ্রাম চরকুঠিবাড়ি থেকে সবে জল নেমেছে। মাটির তৈরি কুঁড়েঘরের মন্দির বিধ্বস্ত। তবুও মা দুর্গার পুজো বলে কথা! ফলে তড়িঘড়ি মন্দির সারানো হল। মাটির মন্দিরের বেদিতে আসীন সাবেকি আদলে গড়া সপরিবার মৃন্ময়ী দেবীদুর্গা। মন্দিরের সামনের ফাঁকা চাতালের মাঝখানে খানে ছয়েক চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। চৌকির উপর মোটা শতরঞ্জি। মাথার উপর টাঙানো রয়েছে সামিয়ানা। মঞ্চের চার কোনের বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে হ্যাজাকের আলো। বিশিষ্ট আলকাপ শিল্পী করুণাময় হাজরা গান ধরলেন,
“বাঁধ ভাঙিল বান আসিল
কোন দেশে পালাই
দিয়াড়ে হয়নি রে কালাই!
ঘর আর বাড়ি ভেঙেছে
ছুটে এল উদ্ধারকারী
সবকে টানিয়ে তোলায়
বুকে ধৈর্য নাহি ধায়
দিয়াড়ে হয়নি রে কালাই!”
হাজার খানেক শ্রোতার দু’গাল বেয়ে তখন ঝরছে অশ্রুর অঝোর ধারা। সে প্রায় আড়াই দশক আগের কথা। এখন মন্দির পাকা হয়েছে। কিন্তু পুজোর আসরে সেই আলকাপ আর নেই।
গত ৩১ অগস্ট কলকাতার সায়েন্স সিটি-র মঞ্চে ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’-এর আসরে করুণাময় হাজরাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু এ বার করুণাময়বাবু আলকাপ পরিবেশন করতে শুধু সপ্তমীর দিন ডাক পেয়েছেন। তিনি বলেন, “এক দশক আগেও বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু হত আলকাপের আসর। শেষ হত দুর্গাপুজো, কালীপুজো, কার্তিকপুজো পার করে একেবারে নবান্নের শেষে।” ভরতপুরের আলকাপ শিল্পী অনিল মাঝি এখন পর্যন্ত এই মরসুমে তিন রাতের বায়না পেয়েছেন। তাঁরও আক্ষেপ, “আলকাপের সুদিন নেই! আগে পুজোতে বায়না ফেরত দিতে হত! এবার তো ৩টি বায়না পেয়েছি। ”
গোকর্ণের দিলীপ বর্মন ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবী দু’জনেই বাউল শিল্পী। দিলীপবাবু বলেন, “দিনকাল পাল্টেছে। আগে পুজোর সময় থেকে শুরু করে শীতের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান থাকত। এ বার সেখানে কেবল তিনটি বায়না পেয়েছি। এখন সবাই ভিডিও আর বিচিত্রানুষ্ঠানে মেতেছে।” অথচ এক যুগ আগেও মফস্‌সলের পূজো প্রাঙ্গণ বাঙালির নিজস্ব সঙ্গীতধর্ম মেনে শ্রীকৃষ্ণ যাত্রা, বাউলগান, আলকাপ, কীর্তন, যাত্রার আসর ছাড়া ভাবাই যেত না। লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক বিশ্বাস বলেন, “আগে দুর্গাপুজো-কালীপুজো মানেই লোকশিল্পের আসর আবশ্যিক ছিল।” লোকশিল্পের জায়গা নিয়েছে অর্কেস্ট্রার দল, বাংলা ব্যান্ড, বিচিত্রানুষ্ঠান। দীপকবাবুর কথায়, “বৈদ্যুতিন মাধ্যমের উন্নতি মানুষের রুচির বদল ঘটিয়েছে। ফলে লোকশিল্পের এই হাল!”
কিন্তু বেঁচে রয়েছে কবিগান। বিশিষ্ট মহিলা কবিয়াল দুলালি চিত্রকরের বাড়ি রঘুনাথগঞ্জের গণকরে। তিনি বলেন, “পঞ্চমী থেকে ত্রয়োদশী পর্যন্ত ৮টি পালা ধরেছি। সময়াভাবে ৮০টি পালা ছেড়ে দিয়েছি।” সাটুই-তারানগরের কবিয়াল কাঞ্চন মণ্ডলও ষষ্ঠী থেকে একাদশী পর্যন্ত দলবল নিয়ে বিভিন্ন পুজো প্রাঙ্গণে আসর জমাবেন। দুলালিদেবী বলেন, “কবিগান নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর দু’জনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী তাত্‌ক্ষণিক যুক্তি-তর্কের গান। ফলে ওই নাটকীয়তাই কবিগানকে টিকেয়ে রেখেছে।” তবে কত দিন টিকে থাকবে তা নিয়ে দু’জনই সংশয়ী। তাঁদের বক্তব্য, “পুজোতে ঢুলি কম থাকে। তাঁরা বেশি টাকা পেয়ে পুজো কমিটির ডাকে চলে যায়। ফলে কবিগান সঙ্কটে।” বহরমপুর নবারুণ সমিতির সম্পাদক অতীশ সিংহ বলেন, “লোকশিল্পকে বাঁচাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, পুজোয় অন্তত দু’দিন লোকশিল্পের আসর বসবে। এ বার থাকছে আলকাপ, বাউল ও গ্রামের দলের যাত্রাপালা।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.