অবশেষে ভোট দেওয়ার অধিকারের পাশাপাশি ভোট না দেওয়ার অধিকারকেও সুপ্রিম কোর্ট স্বীকৃতি দিল। যে কোনও নির্বাচনে ব্যালটপত্রে কিংবা বৈদ্যুতিন ভোট-যন্ত্রে দলীয় ও নির্দল প্রার্থীদের যে তালিকা থাকে, ভোটারদের তাহার মধ্য হইতেই এত কাল কোনও এক জনকে বাছিয়া লইতে হইত। যদি কেন্দ্রের সকল প্রার্থীই অপছন্দের হন, তবে সেই অ-পছন্দ না জানাইবার কোনও উপায় ভোটারের ছিল না। যদি কোনও ভাবে ভোটদাতা কাহাকেও ভোট না দিতে চাহিতেন তবে তাঁহাকে সশরীরে প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে হাজির হইয়া নিজের ভোট বাতিল করিতে হইত। তাহাতে তাঁহার পরিচয় বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্টদের কাছেও অপ্রকাশিত থাকিত না। সুপ্রিম কোর্ট সব দিক বিবেচনা করিয়াই ভোটারের প্রত্যাখ্যানের অধিকারকে মর্যাদা দিতে মনস্থ করিয়াছে।
এই অধিকারের দাবি পুরাতন। শীর্ষ আদালতের অন্য একটি রায়ের সঙ্গে মিলাইয়া পড়িলে এই রায়টি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে শুদ্ধ করার উপায় হিসাবে বন্দিত হইতে পারে। সেই রায়টি হইল দাগি অপরাধীদের প্রার্থী হইতে না দেওয়া কিংবা নির্বাচিত হইলেও জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হারানো সংক্রান্ত, যাহা নাকচ করিতে ইউপিএ সরকার সম্প্রতি একটি বিতর্কিত অর্ডিন্যান্সও জারি করিয়াছে। ইদানীং দলীয় ও নির্দল ভোটপ্রার্থীদের মধ্যে নানা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত, এমনকী আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত ও দণ্ডিত ব্যক্তিরাও জনাদেশে নির্বাচিত হইয়া আইনসভা আলোকিত করিতেছেন। এই প্রবণতা বহু বিবেকবান ভোটারকে ক্রমেই ভোট-বিমুখ করিতেছে, বহু রাজ্যে ভোটদানের হার উদ্বেগজনক ভাবে হ্রাস পাইতেছে। যদি ভোটাররা একটি কেন্দ্রের সকল প্রার্থীকেই প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত রাজনীতিকদের জানাইবার সুযোগ পান, তবে অন্তত দলগুলির তরফে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আর একটু সুবিবেচনার পরিচয় থাকিতে পারে। ভোটদাতারা যেমন প্রার্থী-বাছাই সম্পর্কে তাঁহাদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের কথা এই প্রক্রিয়ায় নথিভুক্ত করিতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলিও তেমনই এই প্রত্যাখ্যান হইতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারে।
প্রশ্ন উঠিতেছে, যদি কোনও কেন্দ্রে অধিকাংশ ভোটার প্রার্থী-তালিকার ‘কাহাকেও নয়’ বোতামটি টিপিয়া থাকেন, তবে কী হইবে? সে ক্ষেত্রে কি নূতন করিয়া প্রার্থী-মনোনয়ন এবং পুনর্নির্বাচন হইবে? প্রশ্নটি গুরুতর। ইহা লইয়া আলোচনা, তর্কবিতর্ক চলা উচিত। বস্তুত, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার সব প্রার্থী প্রত্যাখ্যানের ফলে নির্বাচন বাতিল হইলে দলগুলির উপর যথাযথ প্রার্থী বাছাইয়ের একটি বাড়তি চাপ কাজ করিত। এই সূত্রেই অন্য একটি বৃহত্তর বিষয় প্রাসঙ্গিক হইয়া ওঠে। এই রায় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের সহিত তাহার সম্পর্ক বিষয়ে একটি গভীর প্রশ্ন তুলিয়াছে। অনেক দেশের মতোই ভারতেও নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী কে হইবেন, সেই বিষয়ে ভোটদাতাদের কোনও কার্যকর ভূমিকা বা ক্ষমতা থাকে না। বিভিন্ন দল যাঁহাদের প্রার্থী করেন, তাঁহাদের মধ্য হইতেই আপন পছন্দ বাছিয়া লইতে হয়। পরোক্ষ ভূমিকা হয়তো থাকে রাজনৈতিক দল আপন সাফল্যের তাগিদেই সচরাচর জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাহা যথেষ্ট নহে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী নির্ধারণে ‘প্রাইমারিজ’-এর মাধ্যমে এই প্রয়োজন পূরণের একটি চেষ্টা করা হয়। উহাই শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা না হইতে পারে, কিন্তু দলীয় রাজনীতির নিজস্ব গতি ও প্রকৃতির উপর নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হওয়াই বিধেয়। রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ এই বিষয়ে চিন্তিত হইলে গণতন্ত্রের অমঙ্গল হইবে না। |