|
|
|
|
তিরিশে সেপ্টেম্বর |
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-য়ের আজ জন্মদিন। তাঁর উদ্দেশে শুভেচ্ছালিপি পাঠালেন দুই অভিনেতা। ইন্দ্রনীল
সেনগুপ্ত ও যিশু সেনগুপ্ত। এক জন প্রবাসী বাঙালি। অন্য জন বড় হয়েছেন তাঁর ছবি দেখে, তাঁর পাশে থেকে |
মুম্বইতে টলিউড মানেই প্রসেনজিৎ
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত |
আমি প্রবাসী বাঙালি।
অমদাবাদে মানুষ হয়েছি। তার পর মুম্বই। ছোটবেলায় কেবল-এ ‘আঁধিয়া’ বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। তখন আমি স্কুলে। ছবিতে ছিলেন মুমতাজ আর শত্রুঘ্ন সিংহ। আর সবাইকে বলতে শুনেছিলাম যে, ওখানেই বিশ্বজিতের ছেলে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও আছেন। সেটাই ছিল বুম্বাদার বলিউড ডেবিউ।
মুম্বইতে আসার পরে যে একটা জিনিস বুঝেছিলাম, সেটা হল বাঙালি হোক কি অবাঙালি, সবার কাছে টলিউডের সমীকরণ একটাই। টলিউড= প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
আমার অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘জানালা’। তখন এ শহরে এসে কাজ করে চলে যেতাম। খুব যে বুম্বাদার ছবি কলকাতায় এসে দেখেছিলাম, তা-ও নয়। যখন প্রথম শুনি যে, ‘অটোগ্রাফ’য়ে বুম্বাদার সঙ্গে কাজ করব, আমি জানতাম যে, আই উড হ্যাভ টু বি মাই নরম্যাল সেল্ফ। আমি যদি প্রসেনজিৎ, যিনি কিনা ইন্ডাস্ট্রি, তাঁর বিপরীতে কী করে অভিনয় করব এই নিয়েই চিন্তা করি তা হলে কাজটা ভাল হবে না। আমি জানতাম যে, আমি সুপারস্টারের সঙ্গে অভিনয় করছি। আর ছবির প্রযোজক শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস্। ছবিটা বেশ বড় ধরনের হবে সেটাও বুঝেছিলাম। এটাও জানতাম যে, এই ছবিটা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে।
‘অটোগ্রাফ’-ই ছিল সৃজিতের প্রথম ছবি। অভিনেতা হিসেবে আমি সব সময় পরিচালকের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিই। ওখানেও তাই করেছিলাম। এখানে বলা ভাল যে বুম্বাদার সম্পর্কে আমি অনেকটাই জেনেছি ঋতু (ঋতুপর্ণ ঘোষ)-র কাছ থেকে। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’তে আমি ঋতুর সঙ্গে অভিনয় করেছি। সে সময় ঋতুর মুখে বুম্বাদার কথা শুনতাম। ঋতুর যে ক’টা ছবি আমি দেখেছি তার মধ্যে আমার বুম্বাদাকে ‘দোসর’য়ে সবথেকে ভাল লেগেছিল। প্রায়ই গল্প করার সময় ঋতুকে বলতে শুনতাম, “বুম্বাকে অন্য ধারার ছবিতে আমি নিয়ে আসি।” আর বলত, “বুম্বা, মানুষটা ভাল। ওর মনটা খুব ভাল।” ঋতু নিজের অজান্তেই বুম্বাদা আর আমার মধ্যে একটা স্বচ্ছ সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিল। ‘ব্রেকিং দ্য আইস’ যাকে বলে। বুম্বাদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ‘অটোগ্রাফ’য়ের শু্যটিংয়ে। বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করেছিলাম। আই হ্যাড ফেল্ট দ্যাট ঋতু হ্যাড অলরেডি ইন্ট্রোডিউসড আস টু ইচ আদার উইথআউট বিয়িং প্রেজেন্ট। |
|
‘অটোগ্রাফ’য়ের শেষ দৃশ্যটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। যেখানে আমি বুম্বাদার চরিত্রকে জিজ্ঞেস করি: “তুমি শিওর, তুমি লাস্ট কুড়ি বছর ধরে নিজেকে বিক্রি করোনি? হুঁ? দিনের পর দিন নিজের ক্রিয়েটিভ সত্তার বিরুদ্ধে গিয়ে একের পর এক বাজে বাংলা সিনেমায় পার্ট করোনি?” আর তার পর বুম্বাদার উত্তর: “বিক্রি করেছি, কিন্তু কী জানো? মুখের চামড়া। হাতের আঙুল, আমার কণ্ঠস্বর। ঘাড় বেঁকিয়ে হেসে তাকানো। কিন্তু নট মাই সোল। নেভার। ওটা নিলামে ওঠেনি কোনও দিন। উঠবেও না।” ওয়ান-টেকে ওকে হয়েছিল এই দৃশ্যটা। এর পর আমি বিভিন্ন ধরনের ছবি করতে থাকি। কখনও কলকাতা, কখনও বা মুম্বই। বুম্বাদা কোনও দিনই আমার ইয়ারদোস্ত হয়ে যাননি। আমার সিনিয়র হিসেবে ওঁকে সম্মান করে এসেছি। আর যখনই ওঁর সংস্পর্শে এসেছি, তখনই ওঁর উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়েছি।
বেশ কিছু বছর কেটে গিয়েছে। তার মধ্যে বুম্বাদার সঙ্গে কাজ হয়নি। ‘মিশর রহস্য’য়ে আবার সেই এক টিম। বুম্বাদা, সৃজিত আর আমি। ‘অটোগ্রাফ’য়ের সময় সৃজিত ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন। আজ ওর জনপ্রিয়তা অনেক। বুম্বাদা যে জায়গায় ছিলেন এখনও সে ভাবেই রয়েছেন। এত বছর অভিনয় করার পরে মানুষের অনেক ক্ষেত্রে ক্লান্তি আসে। কিন্তু বুম্বাদার মধ্যে একদম তা দেখিনি। মিশরে কী ঠান্ডার মধ্যে আমাদের অভিনয় করতে হয়েছিল। কিন্তু বুম্বাদার এনার্জি লেভেল ড্রপ করেনি। কোনও দিন শুনিনি যে, সেটে দেরি করে আসবেন। সেই ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি শ্যুটিং। তাও খোলা মরুভূমিতে। কিন্তু বুম্বাদার কোনও ক্লান্তি নেই।
আরও একটা জিনিস দেখেছি বুম্বাদার মধ্যে। তা হচ্ছে, কী করে একজন বহিরাগতকে আপন করে নিতে হয়। আমি প্রথম যখন কলকাতাতে এসে ফ্ল্যাট খুঁজছি, তখন উনি নিজে থেকে আমাকে এক এজেন্টের নম্বর দিয়েছিলেন যাতে বাড়ি খুঁজতে অসুবিধা না হয়। ওঁর কী প্রয়োজন ছিল আমার এই সুবিধা-অসুবিধা দেখার? মিশরে শেষ দিনের শ্যুটিং ছিল এয়ারপোর্টে। আমি তখন সিসিএল-এ খেলছি। দুবাই ফিরতে হবে শ্যুটিং সেরেই। শুধু মাত্র আমার কথা ভেবে উনি ভোর চারটের সময় উঠে এয়ারপোর্টে আসেন যাতে আমি শ্যুটিংটা ঠিক ভাবে করে ফ্লাইট ধরে দুবাই যেতে পারি। এই রকম সহযোগিতা ওই মাপের সুপারস্টারের কাছে পাওয়া তো সৌভাগ্যের।
তিরিশ বছর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে যাওয়াটা সহজ নয়। তার জন্য শুধু অভিনয়-ক্ষমতা থাকলেই হয় না। নিজে পিলারের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে চাই আরও অন্য কিছু। আমার মতো একজন আউটসাইডারকে যে ভাবে বুম্বাদা আপন করে নিয়েছেন তা দিয়েই বুঝতে পারি কেন উনি এত বছর একটা স্তম্ভ হয়ে রয়েছেন।
জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা রইল। ভাল থাকবেন, বুম্বাদা। |
যা দেখেছি |
• না-চাইতে উপদেশ দেন না
•
ঔদ্ধত্য নেই। সহজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। শুধু অভিনেতা বা প্রযোজক নয়, স্পটবয়দের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক
•
দারুণ হেল্পফুল। তা সে বাড়ি খোঁজা হোক বা শ্যুটিংয়ের টাইম অ্যাডজাস্ট করা
•
শুধু আগে কী করেছেন তা নিয়েই ভাবেন না। নিজেকে আজও মেনটেন করেন
•
চিন্তাধারাটা খুব ডায়নামিক। সব সময় নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন |
|
|
আমার বিয়ের বরকর্তা ছিলেন উনি
যিশু সেনগুপ্ত |
প্রথমেই বুম্বাদাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। ওঁর সুস্বাস্থ্য আর দীর্ঘায়ু কামনা করি। যত দিন যাবে ওঁর আরও বেশি মননশীল কাজ দেখতে পাব সেই অপেক্ষায় রইলাম।
বুম্বাদা আমার কাছে বড় দাদার মতো। আমার বাবা উজ্জ্বল সেনগুপ্ত-র সঙ্গে ওঁর আলাপ ছিল ভালই। বাবা মারা যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা বুম্বাদা এসে মাকে বলেছিলেন, “যিশুর জন্য চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই ওর পাশে আছি।”
এই আশ্বাস নিয়েই আমাদের মধ্যে দাদা-ভাইয়ের প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
মনে পড়ে, আমার বিয়ের আগে উনি অনেক দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই সময় ‘জন্মদাতা’ বলে একটা ছবির শু্যটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বিয়ের জোগাড়যন্ত্র কিছুই হয়নি তখনও। কার্ড ছাপানো বাকি। বুম্বাদা দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নেমন্তন্ন-র লিস্ট করা থেকে কী ভাবে কার্ড বিলি করা হবে, কেটারারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেনু ঠিক করা সবেতেই তখন বুম্বাদা। বরকর্তাই হয়ে উঠেছিলেন উনি। বলা যায়, বিয়ের দিন উনি বাবার ভূমিকা নিতেই চেষ্টা করেছিলেন। এ ঋণ ভুলব না। চিরকৃতজ্ঞ থাকব বুম্বাদার কাছে।
এক বার একটা শো করতে গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। হঠাৎ সেখানে একটা গণ্ডগোল। অনুষ্ঠান ছত্রভঙ্গ হল। কলকাতা থেকে খবর পেয়ে বুম্বাদা আমাকে ফোন করে প্রচণ্ড বকুনি দিলেন যে, কেন আমি সিকিওরিটির বন্দোবস্ত রাখিনি। তার পর পুলিশকে ফোন করে সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনলেন। এই রকম অনেক ঘটনাই মনে পড়ে আজ। এ জীবনে বুম্বাদার স্নেহের স্পর্শ পেয়েছি বারবার।
সময় যত এগিয়েছে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আজ এতটাই কাছাকাছি আমরা যে, আমার কোনও কিছু খারাপ লাগলে বুম্বাদা আমাকে ডেকে বকতেই পারেন। এমনকী মারতেও পারেন। এতটাই অধিকার ওঁর আমার ওপর। আর আমারও যদি ওঁর ব্যাপারে কিছু খারাপ লাগে, গিয়ে খোলা মনে অভিযোগ জানাতে পারি। |
|
বুম্বাদার সঙ্গে তিরিশ কি পঁয়ত্রিশটা ছবিতে অভিনয় করেছি। কো-অ্যাক্টর হিসেবে বুম্বাদার তুলনা নেই। কেবল্ শট, মানে অ্যাকশন শট (‘দড়ি দিয়ে বেঁধে যে দৃশ্য শু্যট করা হয়) কী ভাবে দিতে হয় শিখিয়েছেন হাতে ধরে। অভিনয়ের নানা দিক নিয়েও ওঁর কাছে অনেক শিখেছি। যেটাকে বলে টেকনিকালিটিস অফ অ্যাক্টিং। ওঁর ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করার সময় কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, “তুই সিনেমায় বরাবর প্রসেনজিতের ভাই হয়েই থেকে যাবি। নায়ক হওয়া আর হবে না।” এটা ভুল ধারণা। বুম্বাদা কখনও আমাকে গান পয়েন্টে রেখে বলেননি যে, “আমার সঙ্গে তোকে কাজ করতে হবেই।” আমি স্বেচ্ছায়, ভালবেসে বুম্বাদার সঙ্গে কাজ করেছি। আর বুম্বাদাকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। উনি অনেক সিনিয়র। আমি বহু পরে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি। কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু সুপরামর্শ পেয়েছি ওঁর কাছে। আমি যা হতে পেরেছি বা হতে পারিনি, সেটা আমারই যোগ্যতা বা অযোগ্যতার ব্যাপার।
একবার শু্যটিংয়ে গিয়ে আমরা দু’জন মিলে মজা করে ঠিক করলাম কো-অ্যাক্টরদের একটু নাস্তানাবুদ করব। সারা দিন আমি আর বুম্বাদা কপট ভাবে নানা খুঁটিনাটি কারণে ঝগড়া করে গেলাম। সহশিল্পীরা তো রীতিমতো অস্বস্তিতে। কেন যিশুদা আর বুম্বাদা ঝগড়া করছে? শুধু স্বপনদা (স্বপন সাহা) জানতেন আমাদের চক্রান্ত। শু্যটিং যখন শেষ হল আমি আর বুম্বাদা এ-ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তখন সবাই বুঝল আমরা মজা করছিলাম।
অনেক বছর ধরে নানা চরিত্রে ওঁকে অভিনয় করতে দেখেছি, পাড়ার প্রেমিক থেকে, অ্যাকশন হিরো থেকে, দায়িত্বশীল বড় দাদাসব জায়গাতেই অভিনয়ে ওঁর একটা লিডারশিপ থাকত। বুম্বাদার অভিনয় নিয়ে অনেক সময় সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু সে সব কথাও বুম্বাদা চাপা দিয়ে দিয়েছেন একেবারে অন্য ধরনের একেকটি ছবিতে অন্য ঘরানার অভিনয় করে।
কী ‘মনের মানুষ’, কী ‘দোসর’, কী ‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’ সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি ভেঙেচুরে গড়ে নেওয়া এক অন্য প্রসেনজিৎকে। কী ভাবে নিজেকে পরিণত করতে হয় সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন বুম্বাদা আজও।
অভিনেতা হিসেবে, শিল্পী হিসেবে সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদল করাটাই যে একজন শিল্পীর ধর্ম, সেটা বারবার প্রমাণ করছেন। ওঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে লাখো কুর্নিশ জানাই। |
যা দেখেছি |
• অসাধারণ পেশাদারিত্ব
• পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা
• বারবার নিজের ‘লুুক’ বদল করে চরিত্রের মতো হয়ে ওঠা
• সংবেদনশীল মন নিয়ে সহশিল্পী কলাকুশলীদের পাশে দাঁড়ানো
• কাজকে উপভোগ করার মানসিকতা। কাজের জায়গায় একটা আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করে রাখা |
|
|
|
|
|
|