ঘটনার ১১৩ দিন পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য ও চাকরি গ্রহণ করল কামদুনির গণধর্ষিতা ও নিহত কলেজছাত্রীর পরিবার।
শনিবার দুপুরে প্রথম বর্ষের ওই কলেজ ছাত্রীর মা, বাবা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে মহাকরণে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই তাঁদের হাতে নিহত ছাত্রীর মায়ের নামে এক লক্ষ টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। খাদ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক পরে জানান, ওই টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। কাল, সোমবার নিহত ছাত্রীর ছোট ভাইকে রাজ্য সরকারের ‘গ্রুপ ডি’ পদে চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতরে নিহত ছাত্রীর বাবাকে দৈনিক পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে কাজ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। |
মহাকরণে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের কথা এ দিন স্বীকার করেছে নিহত ছাত্রীর ছোট ভাই। তার কথায়, “হ্যাঁ, মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা এক লক্ষ টাকার চেক নিয়েছি। আমাকে সরকারি চাকরিও দেওয়া হচ্ছে।” যদিও সাহায্য নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি নিহত ছাত্রীর বাবা ও মা। তাঁদের বক্তব্য, “চেক কিংবা চাকরির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আমরা মুখমন্ত্রীর কাছে সুবিচার চাইতে গিয়েছিলাম। টাকা ও চাকরি নিলে তো আমরা প্রথমেই নিতে পারতাম। গোড়াতেই আমাদের অর্থসাহায্য ও চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।”
কিন্তু ছোট ভাইয়ের মুখে অর্থসাহায্য ও চাকরি নেওয়ার ঘটনা জানতে পেরে কামদুনির স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই, এমনকী নিহত ছাত্রীর আত্মীয়স্বজনেরাও হতাশ। অনেকে মনে করছেন, এর ফলে কামদুনির প্রতিবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু কামদুনির প্রতিবাদের অন্যতম মুখ, গ্রামের গৃহবধূ মৌসুমী কয়ালের বক্তব্য, “আমরা ওই মেয়েটির কথা ভেবে আন্দোলন করছি। আমাদের আন্দোলন চলবে। মাঝখানে কেউ কেউ লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারেন। কিন্তু আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে একচুলও সরছি না। আমাদের দাবি, দোষীদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।” কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চের পক্ষে ভাস্কর মণ্ডল বলেন, “মহাকরণ থেকে ফেরার পর নিহত ছাত্রীর বাড়ির লোকজন জানিয়েছিলেন, ওঁরা শুধু এলাকার উন্নয়ন ও দোষীদের শাস্তির দাবি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করেছেন। এখন অন্য রকম জেনে খারাপ লাগছে।”
এ দিন মহাকরণে যাওয়া এবং সরকারি সাহায্য পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা না-করা নিয়ে একপ্রস্থ নাটক চলে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা সোনা ঘোষ এ দিন সকালে নিহত ছাত্রীর মা-বাবাকে চিকিৎসার জন্য গাড়িতে করে আরজি কর হাসপাতালে নিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই ছেলেও। হাসপাতাল থেকেই সোজা তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় মহাকরণে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। ততক্ষণে মধ্যমগ্রাম থেকে সেখানে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নিহত ছাত্রীর বাড়ির লোকজনের প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হয়।
এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ কামদুনিতে গেলে প্রথমে ছাত্রীর দাদা জানান দিল্লির নির্ভয়ার ধর্ষণকারী ও খুনিদের মতো যাতে তাঁর বোনের খুনি ও ধর্ষকদের শাস্তি হয়, সেই দাবি তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলার বিচার চলছে, দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে তাঁরা অর্থসাহায্য ও চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন কি না, সে প্রশ্নের জবাব চাওয়া হলে গোটা পরিবারই তা অস্বীকার করে। ছাত্রীর মা বলেন, “টাকা দিয়ে মেয়ের মৃত্যু কিনব? চাকরি বা টাকা নিলে আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে না।”
এর ঘণ্টাখানেক বাদে ছাত্রীর ছোট ভাই বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, কামদুনি স্কুলমাঠের কাছে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে চাকরি ও অর্থসাহায্য নেওয়ার কথা স্বীকার করে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, কিছু ক্ষণ আগেই সে কেন অন্য কথা বলেছিল? এ বার সে বলে, “বাড়িতে চাপ ছিল। তাই, প্রথমে সত্যি কথাটা বলতে পারিনি।” তার দাদাকে ওই সময়ে আর তল্লাটে দেখা যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনও ছিল বন্ধ। ছোট ছেলের এই বক্তব্য জানার পরে বাবার মন্তব্য ছিল, “এমনটা হলে এই ছেলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না।” ছেলে সম্পর্কে মায়ের মন্তব্য, “এমনটা হয়ে থাকলে ওর দিদি ভাইকে কখনও ক্ষমা করবে না।”
খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য দাবি করেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে অনটনের কথা জানিয়ে আর্থিক সাহায্য ও চাকরির আবেদনই জানিয়েছিল ওই পরিবার। সেই অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা নিয়েছেন।” খাদ্যমন্ত্রী জানান, নিহত ছাত্রীর পরিবারকে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার রেশন কার্ড দেওয়া হবে। তাতে ওই পরিবার মাসে ৩৫ কিলোগ্রাম করে খাদ্যসামগ্রী পাবেন। একই সঙ্গে কামদুনি মামলার প্রধান সাক্ষী, মৃত বিমল ঘোষের স্ত্রী বাসন্তী ঘোষকেও সরকারি ‘গ্রুপ ডি’ চাকরি দিচ্ছে সরকার।
খাদ্যমন্ত্রী জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কামদুনির ওই পরিবারের অন্যতম দাবি ছিল, ওই গ্রাম থেকে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত অটো রিকশা চালানোর ব্যবস্থা করুক সরকার। সেই ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান। পাশাপাশি তিনি জানান, কামদুনিতে ইতিমধ্যেই যে পুলিশ ফাঁড়ি হয়েছে, তা-ও থাকবে।
তৃণমূলের পক্ষ থেকেও কামদুনি গ্রামে নানা কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে এ দিন জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান। মৃতা ওই ছাত্রীর স্মৃতিতে আজ, রবিবার কামদুনি শান্তি কমিটির উদ্যোগে রক্তদান শিবির ও বস্ত্র বিতরণ হবে। শান্তি কমিটিই আলোচনা করে ঠিক করবে, আর কী কী কর্মসূচি নেওয়া যায়। কামদুনির প্রতিবাদী মঞ্চের পাল্টা হিসাবে তৃণমূল ওই শান্তি কমিটি গড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। |