উপযুক্ত ব্লাডব্যাগে টান। প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান বাড়ন্ত। তার উপরে চিকিৎসাকর্মীদের একাংশের মধ্যে সচেতনতার অভাব।
পরিণাম যা হওয়ার তা-ই। রক্তের উপাদান আলাদা করতে পশ্চিমবঙ্গে যে সব কেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেগুলি কার্যত ধুঁকছে। সুরাহার বিশেষ উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। যদিও দায় ঝেড়ে ফেলতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে পারস্পরিক দোষারোপের পালা।
একটি মানুষের শরীর থেকে নেওয়া রক্তে অন্তত তিনটি প্রাণ বাঁচতে পারে। কিন্তু তার জন্য দরকার এমন ব্যবস্থা, যেখানে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রক্তের প্রতিটি উপাদানকে আলাদা করা যাবে। পশ্চিমবঙ্গে এমন ১১টি ইউনিট বা কেন্দ্র খোলার অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ন্যাকো), তিন বছর আগে। তার দু’টো এখনও দিনের আলো দেখেনি। বাকিগুলোও মুমূর্ষু। ফলে উদ্যোগটির মূল উদ্দেশ্য অধরাই রয়ে গিয়েছে।
রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ ব্যাপারটা কী?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মানবশরীর থেকে নেওয়া এক ইউনিট রক্তে লোহিত রক্তকণিকা (আরবিসি) শ্বেত রক্তকণিকা (ডব্লিউবিসি), প্লেটলেট, প্লাজমার মতো হরেক উপাদান পাওয়া যায়। বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় লাগে। যেমন থ্যালাসেমিয়া, রক্তাল্পতা বা অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় আরবিসি দরকার। ডেঙ্গিতে প্লেটলেটস। আবার আগুনে পোড়া বা কিডনি বৈকল্যে প্লাজমা দেওয়া হয়। ডাক্তারদের মতে, এক জন রোগীর কখনওই পুরো রক্তের (হোল ব্লাড) প্রয়োজন হয় না। রোগীকে পুরো রক্ত দেওয়ার অর্থ, রক্তের অপচয়। তার চেয়েও বড় কথা, পুরো রক্ত দিলে অনেক রোগীর হৃদ্রোগ, অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
এ সবেরই প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের দাবি: রক্তকে প্রতিটি উপাদানে ভেঙে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করলে এক ইউনিট রক্তে গড়ে অন্তত তিনটি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। ন্যাকোর নির্দেশিকা অনুযায়ী, একটি কেন্দ্রে যত ইউনিট রক্ত সংগৃহীত হবে, তার অন্তত আশি শতাংশের উপাদান আলাদা করে রাখতে হবে। অথচ পৃথকীকরণ কেন্দ্রগুলো খুঁড়িয়ে চলার দরুণ এ রাজ্যে ওই হার গড়ে বড়জোর ২০%। এ হেন শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য মূলত তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (স্যাক্স)-র কর্তারা। কী রকম?
ওঁদের দাবি: উপাদান পৃথকীকরণে প্রয়োজনীয় ব্লাডব্যাগের অভাব, প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানের আকাল এবং রোগী-চিকিৎসকের একাংশের অজ্ঞতায় প্রকল্পটি মার খাচ্ছে। রক্ত নিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা অরবিন্দ বালার অভিযোগ, “এ ক্ষেত্রে এমন ব্লাডব্যাগ দরকার, যেখানে দুই, তিন বা চার রকম উপাদান আলাদা করে রাখা যায়। কেন্দ্র তা পাঠাচ্ছে না।” অরবিন্দবাবুর হিসেব মোতাবেক, গত অর্থবর্ষে (২০১২-১৩) দু’টি উপাদান রাখার মতো ৬০ হাজার ব্যাগ দরকার ছিল, মিলেছে ১৫ হাজার। তিনটি উপাদানের জন্য ১ লক্ষ আর চারটি উপাদানের জন্য ৫০ হাজার ব্যাগ দরকার ছিল। এসেছে যথাক্রমে ১২ হাজার ও ১১ হাজার। “আশ্বাস দিয়েও ন্যাকো ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছে না।” মন্তব্য করেন স্যাক্সের অতিরিক্ত প্রকল্প-অধিকর্তা হিমাদ্রি সান্যাল। মেদিনীপুর ও ন্যাশনাল মেডিক্যালে পৃথকীকরণ ইউনিট চালু না-হওয়ার জন্যও ন্যাকো-কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা।
ন্যাকো পাল্টা রাজ্যের দিকে আঙুল তুলেছে। “পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ব্যাগ কিনে নিতে বলা হলেও তারা রাজ্যের তহবিল খরচে গড়িমসি করছে। চণ্ডীগড়, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য কিন্তু স্বনির্ভর।” যুক্তি কেন্দ্রীয় সংস্থাটির। ন্যাকো-কর্তা অমন
সিংহের যুক্তি, “টেন্ডার ডাকা, ব্যাগের মান ও সংস্থা বাছাই করে সব রাজ্যে সরবরাহ করাটা মুখের কথা নয়। তাই দেরি হচ্ছে।” উপরন্তু অভিযোগ উঠেছে, সচেতনতার অভাবে এখানে অনেক ক্ষেত্রে দু’-তিন-চার রকম উপাদান রাখার ব্যাগ কেটে তাতে ‘হোল ব্লাড’ রাখা হচ্ছে। এতে ব্যাগ অপচয় হচ্ছে। ন্যাকো-র কো-অর্ডিনেটর বিনীতা শ্রীবাস্তবের অবশ্য দাবি, “ব্লাডব্যাগ নিয়ে এখন তেমন সমস্যা নেই।”
ব্লাডব্যাগ জোগানের প্রশ্নে বিতর্ক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে উপযুক্ত কর্মীর অভাব যে যথেষ্ট, রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা তা মেনে নিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, গত প্রায় বারো বছর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ। রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ কেন্দ্রগুলির জন্য মোট ৬০৪ জন টেকনিশিয়ান দরকার। রয়েছেন তিনশো জন। তাঁরাই শিবিরে গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করেন, রক্ত পরীক্ষা করেন, আবার উপাদানও পৃথক করেন! “ফলে কাজ যা হওয়ার, তা-ই হয়।” বলেন এক স্বাস্থ্য-কর্তা। এমনই চলবে?
কর্তাদের প্রতিশ্রুতি, শিগগিরই পাঁচশো টেকনিশিয়ান নেওয়া হবে।
|
রক্ত ভাগ |
ব্লাড ব্যাঙ্ক |
হার (%) |
মানিকতলা
এসএসকেএম
মেডিক্যাল
ন্যাশনাল নীলরতন
আরজিকর
উত্তরবঙ্গ
বাঁকুড়া
বর্ধমান
মালদহ
মেদিনীপুর |
৩৭
১৩
৫০
চালু হয়নি ৪০
১৭
৬
২১
২৫
০.৬৮
চালু হয়নি
|
*২০১১-১২ অর্থবর্ষের হিসেব। তথ্য-সূত্র: স্যাক্স
** ন্যাকোর নির্দেশিকা: সংগৃহীত রক্তের অন্তত
৮০% উপাদান পৃথকীকরণে ব্যবহৃত হতে হবে। |
|