|
|
|
|
সরকারি ঋণে লাখপতি, তবু ভিক্ষে ছাড়ছে কে
জয়ন্ত ঘোষাল • লখনউ |
বড় ইমামবাড়া থেকে হজরতগঞ্জ আসার পথে দেখলাম তাঁকে।
বছর ৩০-৩২ বয়স। উচ্চতা বড়জোর ৫ ফুট। সুশ্রী ভিখারিণী সুরেলা কণ্ঠে গাইছেন, “গরিবো কি শুনো!... তুম এক রুপেয়া দেগা, উয়ো ক্রোড় দেগা তুমহে!’ সঙ্গী হিন্দিভাষী সাংবাদিক সে গান শুনে দিলেন তাঁকে দশ টাকা।
বন্ধুটিকে বললাম, “আমি ভিক্ষা দেওয়ার বিরুদ্ধে। তাই দেব না।” মৃদু তর্কই লেগে গেল দু’জনের। মহিলা ছিলেন দাঁড়িয়ে। আমাদের তর্ক দেখে ধীরে ধীরে সরে পড়লেন। ফেলুদার কায়দায় শ্বাপদ ভঙ্গিতে তাঁর পিছু নিয়ে পৌঁছলাম এক পার্কিং লটে। সেখানে রাখা এক লাল স্যান্ট্রোর সামনে পৌঁছে মহিলা বার করলেন চাবি। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে দরজা খুলে বসলেন চালকের আসনে। ধোঁয়া উড়িয়ে স্যান্ট্রো উধাও হতে আমি হতবাক। বন্ধুবর নন। তিনি বললেন, “বুদ্ধেশ্বর চৌরাহাতে এলে একে রোজ দেখতে পাবে। আদপে বিলাসপুরের শ্রমিক। প্রথম স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় স্বামী চাকরি করে কোনও এক বেসরকারি সংস্থায়। আর বৌ গান গেয়ে প্রচুর টাকা রোজগার করে।” এ-ও শোনা গেল, একটা ছোট কাপড়ের দোকান নাকি করেছেন এই মহিলা। সন্ধের পর তাঁর স্বামী দোকান সামলান।
লখনউ স্টেশনের কাছে আছে এক হনুমান মন্দির। বজরংবলী নাকি এখানে খুবই জাগ্রত। সেই মন্দিরের সামনে ভিক্ষুকদের ভিড়। যাঁদের অনেকেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আছে ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা!
এ এক বিচিত্র কাহিনি। বছর আড়াই আগে, মায়াবতীর আমলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের সমবায় দফতর এক অভিনব প্রকল্প গ্রহণ করে। লক্ষ্য, ভিক্ষুকের সংখ্যা যথাসম্ভব কমানো। সেইমতো এই প্রকল্পে বলা হয়, সমবায় ব্যাঙ্ক ভিক্ষুকদের অর্থসাহায্য দেবে স্বনিযুক্তি প্রকল্পে। ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে তাঁরা ব্যবসা করবেন। তার পর সহজ কিস্তিতে দীর্ঘমেয়াদি পথে টাকা শোধ করবেন। লখনউয়ের প্রায় দেড়শো ভিক্ষুক এই প্রকল্পের অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন। গড়ে মোটামুটি ৩০-৪০ লক্ষ টাকা অর্থসাহায্য নিয়ে এঁদের অনেকেই ব্যবসাপাতি শুরু করেছেন। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়েননি! |
|
বজরংবলীর মন্দিরের সামনে উপবিষ্ট তেমনই এক জন, ৪০ বছরের জিতিন খোলাখুলি স্বীকার করলেন সে কথা। এখনও ভিক্ষে করছেন কেন? জিতিনের উত্তর, “এত দিনের অভ্যেস। ছাড়া সহজ নয়।” শুধুই অভ্যেস, নাকি অর্থাগমের সহজ ও আরামদায়ক পথ? জিতিনের যুক্তি আরাম কোথায়? এই গ্রীষ্ম, এই শীত, এই বর্ষা। কত প্রতিকূলতা, পুলিশের লাঠি খাওয়া। কিন্তু তার পরেও মন্দিরের ফ্রি প্রসাদ খিচুড়ি-হালুয়া-লাড্ডু জুটে যাচ্ছে। ধনী ব্যবসায়ী থেকে মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী পুজো দিয়েই ভিক্ষে দিচ্ছেন মোটা অঙ্কের। ‘জীবসেবা শিবসেবা’-র পথে পাপ ধুয়ে সাফ করার মেড ইজি।
“আসলে ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবাতির সময়টা মন্দিরের প্রাইম টাইম। তখন রোজগারটাও ভাল হয়,” বললেন আসলাম। এঁর কাহিনিও বেশ রোমাঞ্চকর। নিজেই বললেন, “আমি ঋণ নিয়ে চিকন শাড়ি-পাঞ্জাবির ছোট কারখানা করেছি। সেখানে কারিগর আছে। কিন্তু রোজ চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা এই কাজটাও করি।”
সোজা হিসেব সকাল-সন্ধেয় ট্যাক্স-ফ্রি রোজগার। আর সরকারি ঋণের টাকায় ব্যবসা। তবে এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা স্রেফ ব্যাঙ্কে টাকাটি রেখে দিয়েছেন, ব্যবসা করেননি। অথচ ভিক্ষে করে নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধ করে যাচ্ছেন। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসাও হয়নি, ঋণ শোধেরও নাম নেই। ফলে সরকারি কর্তারা ঈষৎ চিন্তিত। অখিলেশ সিংহ সরকারের মুখ্যসচিব জাভেদ উসমানি বলছিলেন, “কত কষ্ট করে এদের ব্যাঙ্ক ঋণ দেওয়া হয়েছিল, জানেন? কারণ এদের প্রায় কারওই সচিত্র পরিচয়পত্র নেই। ঠিকানার প্রমাণপত্র নেই। অন্য কোনও অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে ধরে তাঁকে গ্যারান্টার করে এই টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল।” মুখ্যসচিব জানালেন, মায়াবতীর আমলে কোন কোন ভিক্ষুককে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা এ বার কেস-টু-কেস খতিয়ে দেখা হবে।
আসলে গোটা ব্যাপারটাই এখানে অভিনব এক অসংগঠিত ক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। দীর্ঘদিনের ‘সহকর্মী’ জিতিন-আসলামরা এখন একটা গোষ্ঠী। একটা ‘পিয়ার গ্রুপ’। একসঙ্গে বসেন, খান, প্রেম করেন। নিজেদের মধ্যে বিয়ে-শাদিও হয়েছে। ভিক্ষুকের বাঁধাধরা পরিচয় তাঁদের হাতে পড়ে ভেঙে চুরমার।
লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাহায্যে গোটা দেশের ভিক্ষুকদের নিয়ে গবেষণা করেছেন সমাজবিজ্ঞানী রফিউদ্দিন। তাঁর গবেষণা বলছে, দেশে ভিক্ষাবৃত্তি এখন প্রায় ২০০ কোটি টাকার এক বিকল্প ব্যবসা। দেখা গিয়েছে, মাসে গড়ে ২৪ হাজার টাকাও আয় করছেন কোনও কোনও ভিক্ষুক। লখনউয়েই এমন ভিক্ষুক আছেন, যাঁর শুধু ভিক্ষাবৃত্তির সঞ্চয় লাখ টাকারও বেশি।
তবে এর মধ্যেও অনেক স্তর রয়েছে। রয়েছে ভিক্ষে-মাফিয়া। অলিভার টুইস্টের গল্পের মতো অদৃশ্য বাণিজ্য। হাত-পা কেটে ভিক্ষে করানোর কথা তো সেই কবে থেকে শোনা। অনেকের দাবি, লখনউ শহরে এই ধরনের চক্রে নাকি কিছু রাজনীতিকও যুক্ত। এ শহরের রুমি দরওয়াজার সামনে দেখা মিলবে এই ধরনের প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকদের। এ ছাড়া আছেন কুষ্ঠরোগী ভিক্ষুক। তাঁরা লাইন দিয়ে বসেন জামা মসজিদের সামনে।
নানা ধরনের ভিক্ষুক সমাজ। কিন্তু অভিনব এই দেড়শো জনের কাহিনি। ওই স্যান্ট্রোধারী মহিলা, কারখানা মালিক আসলাম কিংবা জিতিন। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়তে সরকারি সাহায্য নিয়ে যাঁরা আজ বড়লোক, কিন্তু আদি পেশা থেকেও মুক্তিও চান না।
শ্রেণিবৈষম্যের সাবেকি তত্ত্ব গুলিয়ে যাচ্ছে। কার্ল মার্ক্স কি এ দৃশ্য ভেবেছিলেন কখনও? |
|
|
|
|
|