প্রায় কাউকেই বলেননি কোথায় যাবেন।
শনিবার সকাল ৯টা। কলকাতার রডন স্কোয়ারের অফিস থেকে যখন বেরোচ্ছেন, তখনও পুলিশ-প্রশাসন এমনকী, রাজ্য নির্বাচন কমিশনেরও তাবড় অফিসারেরা জানেন না কোন দিকে ছুটবে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দুধ সাদা গাড়ি।
যাচ্ছেন কোথায় মীরা পান্ডে?
বেলা পৌনে ১১টা। লালবাতি লাগানো গাড়িটা পৌঁছেছে বিটি রোডে, সোদপুর পেট্রোল পাম্পের কাছে। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল এবং ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার বিশাল গর্গ ততক্ষণে জানেন, নির্বাচন কমিশনারের গন্তব্য পানিহাটি। সকাল থেকেই ভোট নিয়ে গোলমাল-হুজ্জতির নানা অভিযোগে তেতে রয়েছে যে এলাকা।
কিন্তু মীরাদেবীর সঙ্গে তো প্রথাগত পুলিশ-এসকর্টও নেই? অতএব অনুরোধ, “একা যাবেন না। একটু অপেক্ষা করুন। এসকর্ট যাচ্ছে।” |
সামনে পুলিশের পাইলট-কার নিয়ে পানিহাটি পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ত্রাণনাথ স্কুলের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে মীরাদেবী পৌঁছলেন বেলা ১১টায়। তাঁকে দেখে ডুকরে উঠলেন কংগ্রেস প্রার্থী দীপা চট্টোপাধ্যায়। অভিযোগ করলেন, “ছাপ্পা ভোট দেওয়ার প্রতিবাদ করায় ওরা (তৃণমূল) আমার বুকে-পিঠে মেরেছে ম্যাডাম। গলার হারটাও কেড়ে নিয়েছে।” মীরাদেবীর আশ্বাস, “চিন্তা করবেন না, দেখছি।” বুথে ঢুকে পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথার ফাঁকে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “এখানে পুলিশ এত কম কেন?” পুলিশদের মধ্যে কে লাঠিধারী, কে বন্দুকধারী, তা-ও খোঁজ নেন।
পরের গন্তব্য, ৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই নববঙ্গপল্লি। ততক্ষণে রটে গিয়েছে খবর। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের গাড়ির পথ আটকে বনেটে চাপড় মেরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন এলাকার সিপিএম এবং কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। দাবি তোলেন, গাড়ি থেকে নেমে মীরাদেবীকে অভিযোগ শুনতে হবে। বিক্ষোভকারীদের জন্য অন্তত বার চারেক থেমে বেলা পৌনে ১২টায় বিবেকানন্দ শিক্ষা নিকেতনের ভোট-কেন্দ্রে পৌঁছন তিনি।
প্যাচপেচে কাদা পেরিয়ে রাস্তা থেকে ফুট তিরিশেক দূরে বুথ। নীল রঙের শাড়ি সামান্য গুটিয়ে মীরাদেবী সেখানে বিনা ঝামেলায় পৌঁছলেও তাঁকে ঘিরে রাখা পুলিশকর্মীরা ভিড়ের চাপে হিমশিম খান। পুলিশের পাহারা এড়িয়ে নির্বাচন কমিশনারের সামনে পৌঁছনোর মরিয়া চেষ্টা করছিলেন এক মাঝবয়সী ব্যক্তি। পুলিশের ঘেরাটোপ পেরোতে না পেরে তিনি আক্ষরিক অর্থেই পথে বসে কাঁদতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, “সিপিএম করি। ৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই ভোটার। আমার ভোট অন্য কেউ দিয়েছে। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তৃণমূলের ছেলেরা ঘাড়ধাক্কা দিল। আধলা ইট ছুড়ে মারল। মাথা ফেটে গিয়েছে। ভেবেছিলাম, মীরাদেবীকে অভিযোগটা জানাতে পারব!” ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী তপতী দেবনাথকে শোনা যায় চিৎকার করতে, “আমাদের পোলিং এজেন্টকে সকালেই বুথ থেকে বার করে দিয়েছে তৃণমূল। কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। পথে দেখলে মারধর করেছে।” আলাদা করে তপতীদেবীর কথাও শোনেন মীরাদেবী। তবে তিনি যখন ওই ভোট-কেন্দ্র থেকে বেরোতে যাচ্ছেন, তাঁর গাড়ি ফের ঘিরে ফেলেছে জনতা। উড়ে আসছে অনুরোধ, “ম্যাডাম একটু দেখুন।” পুলিশকর্মীরা হাতজোড় করে অনুরোধ জানানোর পরে জনতা পথ ছাড়ে। |
বিক্ষোভ না হলেও নির্বাচন কমিশনারকে স্রেফ চোখের দেখা দেখতে উপচে পড়া ভিড় ছিল ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পানিহাটি শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যাপীঠের বুথের আশপাশের বাড়ি, রাস্তার ধারেও। সেখানে অপেক্ষারত সংবাদমাধ্যমের উপরে চড়াও হন তৃণমূলের এক মহিলা নেত্রী। মারমুখী মহিলার মুখঝামটা, “আপনারা অপপ্রচার করছেন। যে কারণে মীরা পান্ডে এখানে এসেছেন।” পৌনে ১টা নাগাদ মীরাদেবী পৌঁছন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের নন্দনকানন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলের বারান্দায় বেঞ্চে বসে জেলাশাসক এবং কমিশনারকে নিয়ে ছোটখাট মিটিংও করেন। সেখানেও জনতা হামলে পড়ে ‘ম্যাডামের’ কাছে অভিযোগ জানানোর দাবিতে। তবে পুলিশ তাদের ঘেঁষতে দেয়নি।
বেলা সওয়া ১টা নাগাদ ফের বিক্ষোভের মুখে নির্বাচন কমিশনার। তবে এ বার বিক্ষোভকারীরা শাসক দলের। পানিহাটি হাসপাতালের উল্টোদিকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাঠগোলা উদয়ন সঙ্ঘের বুথে তখন হাজির পানিহাটি পুর নির্বাচনে তৃণমূলের দুই পর্যবেক্ষকব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত এবং নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। |
নবীনা ও প্রবীণা |
ভোটের লাইনে মোবাইলে
মগ্ন নতুন ভোটার। |
পুলিশের সাহায্যে ভোট দিচ্ছেন
এক বৃদ্ধা। পানিহাটিতে। |
|
মীরাদেবী বুথে ঢুকতেই হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলা চিৎকার করতে থাকেন, “ম্যাডাম, দেখুন আমাদের বুথ-ক্যাম্প কী ভাবে ভাঙচুর করেছে সিপিএম।” মহিলার দিকে এগোতেই মীরাদেবীকে ঘিরে ফেলেন শ’খানেক পুরুষ তৃণমূল কর্মী। তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন, “মীরা পান্ডে গো-ব্যাক। সিপিএমের দালাল মীরা পান্ডে হুঁশিয়ার।” পুলিশকর্মীরা ঘিরে নিয়ে যাচ্ছিলেন তবে তারই ফাঁকে মীরাদেবীকে ধাক্কা মারার চেষ্টা করেন কয়েক জন। গাড়িতে ওঠার মুখে তাঁরা থুতুও ছেটান। মীরাদেবীর গায়ে লাগেনি। তবে তাঁর গাড়ির কাচ এবং বনেট ঝাপসা হয়ে যায় থুতু-বৃষ্টিতে।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ অবশ্য বলেন, “শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিজেই সন্ত্রাস তৈরি করলেন। সকাল থেকে যতক্ষণ নির্বাচন চলল, উনি পানিহাটিতে পড়ে থাকলেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বুথ জ্যাম করে ভোটারদের ভোট দিতে দিলেন না। তাই ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে জনতার বিক্ষোভের মুখে পড়লেন।”
বেলা দেড়টায় মীরাদেবীর গাড়ি ফের কলকাতামুখী। সাদা গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বৃদ্ধ বলে ফেলেন, “আগের জমানাতেও ভোটের দিনটায় যেমন অস্বস্তি হত, এই আমলেও তা-ই হচ্ছে। ম্যাডামকে সেটা সাহস করে বলে উঠতে পারলাম না।”
|