পিকুর বয়স মেরেকেটে চার, তার বেশি নয়। ন’মাস বয়সে মাকে হারিয়েছে। তার পর থেকে ঠাম্মার হেপাজতে। অবশ্য ঠাকুরদাও সঙ্গ দেয়। যদিও পিকু ঠাকুরদাকে ‘বাবু’ বলে ডাকে। অফিসের কাজে বাপি ব্যস্ত থাকে। একমাত্র ছুটির দিনে বাপির নাগাল পায়। মাকে তার মনে পড়ে না। শুধু ছবিতে দেখে। এক দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাপি তাকে কোলে নিয়ে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ছবিতে রজনিগন্ধা ফুলের মালা দুলছিল ফ্যানের বাতাসে। বাপি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। ঠাম্মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কিছু একটা লুকোতে চেষ্টা করে। বাড়িতে যেন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। পিকুর মন খারাপ লাগে। কান্না পায়। তার পর বিছানায় শুয়ে চুপি চুপি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। পর দিন সকালে বাবু খবরের কাগজ পড়ছিল, তখন পিকু তার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাল রাতে বাপি অমন করছিল কেন?’ বাবু পিকুর মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘কাল মীনার, মানে তোমার মায়ের চলে যাওয়ার দিন ছিল।’ পিকু আর কথা বলে না। শুধু ঠাকুরদার বুকের ধুকপুক শব্দ বেশ স্পষ্ট শুনতে পায়।
মীনা পিকুর মায়ের নাম। সে বাবুর কাছে জেনেছে, মীন শব্দের অর্থ মাছ। বৃহস্পতিবার ছাড়া, বাড়িতে রোজই মাছ আসে। সে দিন বাড়িতে ঠাম্মা লক্ষ্মীপুজো করে। তাই মাছ বন্ধ। মাছ খেতে পিকুর ভাল লাগে না। বড্ড কাঁটা। ঠাম্মা ছাড়ে না। কোলে বসিয়ে কাঁটা বেছে যত্ন করে খাইয়ে দেয়; আর বলে, ‘যদি মাছটা খেয়ে নিস, তা হলে রাতে একটা গল্প বলব।’ বাপির তো বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। ততক্ষণ পিকু জেগে থাকতে পারে না। তাই ঠাম্মা তাকে ঘুম পাড়াবার আগে গল্প বলা শুরু করে। কিন্তু গল্পের শেষটা পিকু কখনওই শুনতে পায় না। ঠাম্মার গলার আওয়াজ কেমন ভেসে চলে যায়... কোথায়... কত দূর...। ঠাম্মা চার-পাঁচটা গল্প জানে। শেয়ালের গল্প, নাপিতের গল্প, রাজকন্যার গল্প, মাছের গল্প...। সেগুলোই ঘুরিয়েফুরিয়ে বলে। |
পিকু এখনও স্কুলে যায়নি। তবে ঠাম্মা বলেছে, সামনের বছর কে জি ক্লাসে ভর্তি হবে। স্কুলকে ঠাম্মা ‘ইস্কুল’ বলে। ঠাম্মা কেন এমন বলে, তা পিকু জানে না। তবে পিকুর মাসতুতো দাদা স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ে। পিকুর মাসতুতো দাদার নাম সজল। সবাই টিটো বলে ডাকে। পিকুর টিটোদা মোটা মোটা বই পড়ে। ইংরেজি ভাষায় লেখা। মাস দুয়েক আগে বাপির সঙ্গে পিকু মাসিমণির বাড়ি গিয়েছিল। টিটোদা বাড়িতে ছিল না। তবে পিকু চুপিচুপি টিটোদার পড়ার ঘরে ঢুকে সেই সব বইপত্তর নেড়েচেড়ে দেখে এসেছে। একটা বইতে অনেক রঙিন ছবি আছে, ব্যাঙের ছবি, পাখির ছবি, কচ্ছপের ছবি, মাছের ছবি...।
সে দিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই পিকু শুনল সুখবরটা আজ মাসিমণি, টিটোদা, মেসোমশাই দুপুরের আগেই তাদের বাড়িতে আসবে। তার মানে খুব খাওয়াদাওয়া! আর মাসিমণি তার জন্য অবশ্যই আনবে একটা গিফ্ট প্যাকেট। খুশিতে পিকুর মনটা নেচে উঠল। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ির ডোরবেল বেজে উঠল। পিকু টিভিতে ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দেখছিল। টিভি অফ করে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। মাসিমণি তার হাতে একটা প্যাকেট তুলে দিল। মেসোমশাই তাকে কোলেই তুলে নিল। এই দেখে টিটোদা মিটিমিটি হাসছিল। পিকু প্যাকেট পেয়ে বেজায় খুশি। পরে খুলে দেখবে। ঠাম্মা শিখিয়েছে, দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট খুললে লোকে হ্যাংলা বলবে। তাই পিকু সচেতন ছিল। চা-কফি নিয়ে জমে উঠল আড্ডা। বাবু, বাপি আর মেসোমশাইয়ের গল্প যেন শেষ হয় না! ঠাম্মা, মাসিমণি রান্নাঘরে ব্যস্ত। রান্না চলছে, আর চলছে বকর বকর। টিটোদা সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। পিকুর দিকে চোখ পড়তেই টিটোদা বলল, ‘কী পিকুবাবু! খবর কী?’ পিকু এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কাছে যেতেই টিটোদার টি-শার্টে একটা মিষ্টি গন্ধ পেল। বোধ হয় সেন্ট-এর। পরনে হাল্কা নীল রঙের টি-শার্ট, আর ফেডেড জিন্সের প্যান্ট। ফরসা রং, মুখে পাতলা দাড়ি-গোঁফ, চুলে শ্যাম্পু। টিটোদাকে বেশ মানিয়েছে। পিকু মনে মনে টিটোদাকে অনুসরণ করে। বড় হয়ে সেও টিটোদার মতো সাজগোজ করবে।
টিটোদার কোল ঘেঁষে পিকু বলল, ‘একটা গল্প বলো।’ টিটোদার উত্তর, ‘গল্প তেমন জানি না। তবে একটা অদ্ভুত ঘটনা বলতে পারি।’ পিকু বলল, ‘তাই বলো। ঘটনাটা কীসের?’ টিটোদার জবাব, ‘এক ধরনের মাছের কথা, মাছটার নাম স্যামন। এরা ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশান্ত মহাসাগরে থাকে। সেই মাছগুলোর মধ্যে বিশেষ করে মা-মাছগুলো ডিম পাড়ার সময় সমুদ্রের নোনা জল ছেড়ে উত্তর আমেরিকার মিষ্টি জলের নদীতে ঢুকে পড়ে। বাকিরাও সঙ্গে থাকে। নদীগুলো খুব খরস্রোতা। স্রোতের বিপরীতে তাদের সাঁতার দিতে বেশ কষ্ট হয়। তার পর পাথুরে অঞ্চলে আছে জলপ্রপাত। বেচাল হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। তবু উজান বেয়ে এমন একটা জায়গায় তারা এসে পৌঁছয়, যেখানে নদীর গভীরতা কম।’ পিকু প্রশ্ন করে, ‘কখন স্যামন মাছেরা সাগর থেকে নদীতে আসে?’ টিটোদা খুশি হয়ে বলল, ‘ভাল প্রশ্ন। শোন, প্রতি বছর অগস্ট মাস নাগাদ তারা প্রশান্ত মহাসাগর ছেড়ে নদীতে প্রবেশ করে। কয়েকশো মাইল পেরিয়ে নদীর অগভীর অঞ্চলে, যেখানে নুড়ি-পাথর আছে, সেখানে পৌঁছতে শীতকাল এসে যায়। সেখানেই ডিম পাড়ে মা-মাছেরা। পথের পরিশ্রমে ক্লান্ত, পাথরের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত মাছের দল সেখানেই হাজারে হাজারে মারা যায়।
এ দিকে পাথরের ফাঁকে জমে থাকা লক্ষ লক্ষ ডিম ফুটে বাচ্চা হতে বসন্ত এসে যায়। তারা বড় হয়ে নদীর পথ ধরে আবার সাগরে ফিরে যায়। পরের বছর সেই মাছের দল একই পথ ধরে আবার ওই জায়গায় ফিরে আসে। আর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।’ টিটোদাকে থামিয়ে পিকু হঠাত্ বলে ওঠে, ‘সে দিন ঠাম্মা বলছিল, পুঁটি আর মৌরলা মাছেরও এমন হয়। মা মাছেরা ডিম পাড়ার পর আর বাঁচে না।’ টিটো একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ওরে বাবা, তুই তো দেখছি বেশ খবরাখবর রাখিস। ঠিকই বলেছিস তুই। আর সেই জন্যই তো তোকে এত ভালবাসি।’
এমন সময় রান্নাঘর থেকে ঠাম্মার ডাক শোনা গেল, ‘পিকু, টিটোদাদাকে নিয়ে খাবি আয়।’ খেতে খেতে আর মাছের কথা তেমন হল না। বাপিরা অন্য কথা বলতে লাগল। বিকেলের দিকে মাসিমণিরা ফিরে গেল।
সারা দুপুর হইচই। সন্ধেবেলায় বেশ ঝিমুনি আসছিল পিকুর। আধ তন্দ্রায়, আধ জাগরণে সে ভাবছিল মাছগুলোর কথা। মাছ মানে তো মীন। আর মীনা তার মায়ের নাম। মাও তো জন্মের কয়েক মাস পরে চলে যায়। ঠাম্মা তো তাই বলে। তার পর আর কোনও দিন দেখা করতে আসেনি, পিকুসোনা বলে আদর করেনি। সে তো মায়ের কথা ভাবে। মা কি তার পিকুর কথা ভাবে? কে জানে। ভাবতে ভাবতে পিকুর ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। সে স্বপ্ন দেখে, হাজার মাছের ঝাঁকে পিকুও সাঁতার দিচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নদীপথে সেও চলেছে তাদের সঙ্গে। একটা মাছকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মায়ের নাম কী?’ মাছ তার উত্তর না দিয়ে পিকুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মা কে?’ পিকু বলল, ‘আমার মায়ের নাম মীনা। তুমি তাকে চেনো? তার সঙ্গে দেখা হলে একটু বলবে, পিকুসোনার কাছে যেন এক বার আসে। বলবে কেমন! ভুলে যেয়ো না কিন্তু!’ পিকু নড়ে উঠল। ঠাম্মা ঠেলা দিয়ে তাকে মৃদু বকুনি দিলেন। ‘পিকু, ঘুমলে চলবে? রাতের খাবার খেয়ে নে। তার পর শুবি। চল বাবা, খাবি চল।’ পিকুর চোখে তখনও মীনের স্বপ্ন লেগে আছে। |