|
|
|
|
বীণা-টুম্পাদের দেখানো পথেই ‘শক্তিরূপেণ’
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বীণা-রেখা-টুম্পাদের লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি।
শুধু প্রেক্ষাপটই আলাদা।
প্রথম পর্যায়ে বীণা-কালিন্দিদের লড়াইটা ছিল বাল্যবিবাহের প্রতিবাদ করে পড়াশোনার জগতে ফেরার। পুরুলিয়ার তস্য গ্রামে থেকে সেই লড়াই ছিল কঠিন। কিন্তু তারা দাপটে জিতেছিল আর সেই সঙ্গে জেতার একটা খিদে তৈরি করে দিয়েছিল তাদেরই মতো অন্য মেয়েদের মধ্যে। এ বার পরবর্তী যুদ্ধটা শুরু হয়েছে পড়ার জগতে টিকে থাকার।
ভুরসা গ্রামের বীণা এখন বাঘমুন্ডি কস্তুরবা গাঁধী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে থাকে। পড়ে বাঘমুন্ডি হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে। গোটা বাঘমুন্ডি থানায় এই একটাই মেয়েদের হস্টেল। তা-ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত! পাহাড়ি গ্রামের মেয়েরা হস্টেল ছাড়া কী করে মাধ্যমিকের পড়া পড়বে? দুর্গম জঙ্গলের পথে রোজ স্কুলে যাতায়াত অসম্ভব। এ দিকে বীণা-রেখাদের প্রতিবাদের পরে তাদের গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনার হার বেড়ে গিয়েছে। টেলিফোনের এ পার থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল বীণা-র গলার উত্তেজনা “আমরা অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত হস্টেল চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব। নয়তো ক্লাস এইটের পরে আমাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। এত লড়াইয়ের মানেই থাকবে না।”
কোথা থেকে আসে গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের একরত্তি মেয়ের এত মনের জোর? কে শক্তি জোগায়? মেয়ে বলে, “মনের ভিতর থেকেই তো কেমন একটা ধাক্কা আসে। মনে হয়, করতেই হবে।”
পুরুলিয়া থেকে অনেক দূরে উত্তর ২৪ পরগনার এক অখ্যাত, পুঁচকে গ্রাম রাতারাতি নামী হয়ে গিয়েছে একদল মেয়ের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে। গ্রামেরই এক মেয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যুর প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিলেন কামদুনির টুম্পা-মৌসুমীরা। তাঁদের বিক্ষোভে মিশে গিয়েছিল অসংখ্য মেয়ের পা। ঘোমটা দেওয়া নিতান্ত গ্রাম্য বধূদের এই রূপান্তর সম্ভব হল কোন শক্তিতে? টুম্পা কয়াল জবাব দেন, “আমরা যা করেছি, মনের তাগিদে। হঠাৎ ভিতরে আগুন জ্বলে উঠল। রাগটা বেরিয়ে এল। ভাগ্যিস এল! এখন মনে হয়, একটা মেয়ের মতো কাজ করেছি। গ্রামের কোনও মেয়ে আজ প্রতিবাদ করতে ভয় পায় না। তারা অন্যায়ের জবাব দিতে শিখে গিয়েছে।”
এই অজেয় শক্তিই গত একযুগ ধরে দেখিয়ে চলেছেন মণিপুরের ইরোম শর্মিলা চানু। বিতর্কিত ‘সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন’ প্রত্যাহারের দাবিতে বারো বছরের বেশি সময় ধরে চলছে তাঁর অনশন আন্দোলন। যা নাড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দিল্লি সরকারকে। শক্তিশালী রাজনীতিকদের ক্ষমতা হয়নি একলা মেয়েকে নিরস্ত করার। ইম্ফল থেকে চানুর ভাই ইরোম সিংহজিৎ জানান, ইম্ফলের ‘জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ বোনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল গত ১৮ সেপ্টেম্বর। তখনও চানু তাঁকে বলেছেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন ভারতের সব মেয়ে এই আন্দোলনের জন্য নিজেদের সর্বস্ব পণ করেছেন।
যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মেয়েদের সরব হওয়ার কথায় দপ করে জ্বলে উঠেছিল সম্পত পাল দেবীর গলাও। উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলায় ‘গুলাবী গ্যাং’-এর প্রধান সম্পত। পাঁচ ছেলেমেয়ের মা সম্পত ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী। গ্রামে মেয়েদের উপর অহরহ অত্যাচার চোখের সামনে সহ্য করতে না পেরে গ্রামের মেয়েদের নিয়ে ২০০৬ সালে তৈরি করেন লেঠেল বাহিনী। অত্যাচারী পুরুষের বাড়ি গিয়ে তাকে পিটিয়ে শায়েস্তা করার কাজ শুরু করে সেই বাহিনী। আজ তার শাখা ছড়িয়েছে বুন্দেলখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে। তাঁকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা হচ্ছে। বাদৌসা গ্রাম থেকে টেলিফোনে সম্পত বলেন, “মেয়েরা যত সইবে, অত্যাচারীরা তত পেয়ে বসবে। প্রতিবাদ করো, শক্তি দেখাও। মেয়েরা সত্যি দুর্গার অংশ। অসুর নাশ করতেই তাঁদের জন্ম।”
এই শক্তিতেই হামলাকারীদের গুলির পরোয়া না-করে ষোলোয় পা দেওয়া মালালা ইউসুফজাই রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগানো আত্মবিশ্বাসে বলেন, “গলার জোর বোঝাতে আওয়াজ ওঠাচ্ছি না। আমি আসলে তাঁদের কথা বলতে চাই যাঁদের কথা শোনা যায় না। কারণ আমি জানি, আমাদের মধ্যে অল্প কয়েক জন মেয়েও যদি পিছিয়ে থাকে, তা হলেই মেয়েদের অগ্রগতি ধাক্কা খাবে।”
পশ্চিমবঙ্গের গণ্ডী পেরিয়ে অন্য রাজ্য এমনকী ভিন রাষ্ট্রেও আত্মশক্তিতে দীপ্ত, ঘুরে দাঁড়ানো ‘শক্তিরূপেণ’ নারীর সামনে নতজানু যাবতীয় প্রতিরোধী কু-শক্তি। নারীজাগরণের নির্যাসটাই নিরন্তর ছড়িয়ে চলেছেন এই মেয়েরা। এই নির্যাস হল ‘আত্মশক্তিকে উপলব্ধি করা, এগিয়ে যাওয়ার পথে সমস্ত বাধা ভেঙে দেওয়া, মুক্তি আর ক্ষমতায়ণের বৃত্তের প্রসার ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মেয়েদেরও সঙ্গে নেওয়া’।
প্রতিটি মেয়ের ভিতর সুপ্ত থাকা শক্তির আধারে নাড়া দিতেই একটি সচেতনতা কর্মসূচির পরিকল্পনা হয়েছে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘অম্বুজা সিমেন্ট’-এর সেই কর্মসূচি-ই হল ‘শক্তিরূপেণ’। এই কর্মসূচির শরিক অভিনেত্রী রাইমা সেনের কথায়, “মেয়েরা এখন অনেক প্রতিবাদী, অধিকারসচেতন। এই সচেতনতার পরিধি বাড়ানোর কাজে শরিক হওয়া আমাদের দায়িত্ব।”
এই কর্মসূচিতে থাকছে একটি টোল ফ্রি নম্বর ০২২৩৩৫৯৮৫৮৫। এই নম্বরে মহিলারা মিস্ড কল দিলেই তাঁদের একটি এসএমএস পাঠানো হবে। সেই এসএমএস দেখিয়ে কলকাতার যে কোনও ‘ক্যাফে কফি ডে’ বা ‘বিগবাজার’ থেকে তাঁরা পেয়ে যাবেন ‘শক্তিরূপেণ ব্যাজ।’ দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁদের আত্মরক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতির প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং নারী অধিকার সংক্রান্ত আইনের পাঠ দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। |
|
|
|
|
|