অ্যাপল-দুনিয়ার দুই নয়া ‘মডেল’। শুক্রবারই প্রথম পা রেখেছে ১১টি দেশে। আর প্রথম দিন থেকেই তাঁদের ঘিরে ফিরছে চেনা আইফোন-উন্মাদনা। কোথাও এক কিলোমিটার লম্বা লাইন, কোথাও বা মারামারি ও পুলিশি হস্তক্ষেপ সব কিছুর কেন্দ্রেই আইফোন ফাইভ এস এবং আইফোন ফাইভ সি। স্মার্টফোন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যাঁরা এত দিন অ্যাপলের পড়তি বাজার নিয়ে সুর চড়াতেন, তাঁদেরও ধারণা, পূর্বসুরিদের ঐতিহ্য অনায়াসে ধরে রাখবে এই নয়া দুই মডেল। অন্তত শুক্রবারের ছবিটা তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত কাল প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি, হংকং, জাপান, পুয়ের্তো রিকো, সিঙ্গাপুর এবং ব্রিটেন এই ১১টি দেশে ফাইভ এস এবং ফাইভ সি মডেল দু’টি এনেছে অ্যাপল। আর আসতে না আসতেই ‘হট কেকের’ মতো বিক্রি হয়েছে সেগুলি। বাকি ছবিটাও চেনা। রাতভর অ্যাপল বিপণির সামনে লম্বা লাইন, দোকানের ঝাঁপ খুলতে না খুলতেই উপচে পড়া ভিড়, এ সব তো ছিলই। তাতে নয়া সংযোজন বলতে মারামারি। পাসাডেনার অ্যাপল বিপণির সামনে লাইন দিতে বৃহস্পতিবার ডাউনটাউন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বেশ কিছু গৃহহীনকে ‘ভাড়া’ করে নিয়ে আসা হয়। ক্রেতাদের হয়ে রাতভর তাঁরাই লাইনে বসেন। কিন্তু অভিযোগ, যিনি এই কাজের ‘বরাত’ দিয়েছিলেন তাঁদের, আইফোনগুলি পেয়ে যাওয়ার পর সেই ব্যক্তি প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে রাজি হননি। ব্যস, ক্ষেপে ওঠে গৃহহীন জনতা। শেষমেশ পুলিশ এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সেই ব্যক্তিকে। তার আগে ওই বিপণির সামনেই দুই ব্যক্তি হাতাহাতি করছিলেন। সব মিলিয়ে শুক্রবার ওই বিপণির সামনে থেকে তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। |
নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের অ্যাপল বিপণির সামনে ছবিটা ছিল অন্য রকম। সেখানে এক দিন বা দু’দিন আগে থেকে নয়, প্রায় পনেরো দিন আগে থেকে ঘাঁটি গেড়েছেন অনেকে। যেমন বছর উনিশের সুরকার ব্রায়ান সেবাল্লো। আইফোন ফাইভ এস হাতে ধরে তাঁর তৃপ্ত মন্তব্য, “প্রতি বারই অ্যাপল নতুন চমক দেয়।”
এ তো গেল আমেরিকার ছবি। কিন্তু আইফোন-উন্মাদনার নিরিখে কোনও অংশেই যে পিছিয়ে নেই টোকিও, বেজিং, তাও শুক্রবার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলিশের হিসেব মতো, শুক্রবার সকালে যখন অ্যাপলের বিপণিগুলি খোলে, তখন কোনও কোনও বিপণির সামনে প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা লাইন। আবার কারও কারও মতে, শুক্রবার নয়, গত সপ্তাহান্ত থেকেই ক্রেতাদের এমন ঢল প্রত্যক্ষ করছে টোকিওর সুপারমার্কেট। বেজিংয়ের উন্মাদনা অবশ্য বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আসলে ২০১১ সালে চিনের বাজারে যখন আইপ্যাড টু আনে অ্যাপল, তখন লম্বা লাইনে পদপিষ্ট হয়ে গুরুতর জখম হয়েছিলেন চার জন। এ বার থেকে তাই ‘অনলাইনে’ অগ্রিম বুকিং সেরেছেন বেজিংবাসী। সেখানে চোখ রাখতেই থতমত খেয়ে গিয়েছেন অনেকে। অনলাইন বুকিং খোলার মাত্র আধ ঘণ্টা পর যাঁরা বুকিং করেছেন, কম্পিউটার বলছে, আইফোন ফাইভ এস হাতে পেতে পেতে অক্টোবর। অর্থাৎ ‘ভার্চুয়াল’ মারামারি অনলাইনেও।
কিন্তু কেন এই উন্মাদনা?
আইফোন ফাইভ এসের ইউএসপি প্রযুক্তির অভিনবত্ব। প্রথমত, পূর্বসুরি আইফোন ফাইভের থেকে অনেক দ্রুত কাজ করবে এটি। সৌজন্যে আরও আধুনিক প্রসেসর। দ্বিতীয়ত, ফোন ‘আনলক’ করতে লাগবে ব্যবহারকারীর নিজের আঙুলের ছাপ। অর্থাৎ ব্যবহারকারী বাদে ফোনের তথ্য অন্য কারও পক্ষে ঘেঁটে দেখা প্রায় অসম্ভব। তৃতীয়ত, এতে রয়েছে উন্নত হার্ডওয়্যার। চতুর্থত আধুনিক ক্যামেরা। এইটিসি, স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ফোরের মতো হরেক কিসিমের ‘ফিচার’ না দিলেও সুক্ষ্ম তথ্যসমেত পরিষ্কার ছবি তুলছে আইফোন ফাইভ এসের স্লো মোশন ক্যামেরা। সব মিলিয়ে তাই অ্যাপল-ম্যাজিক ফিরিয়ে আনছে এটি।
আইফোন ফাইভ সির ক্ষেত্রে বাজার-দর্শনটা আবার আলাদা। ফাইভ এস যেখানে অ্যাপলের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অবদান, সেখানে ফাইভ সির মূল উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার ধরা। অ্যাপলের দাবি, সে কারণে কম দাম ধার্য করা হয়েছে ফাইভ সির। তথ্য বলছে, আমেরিকায় ৯৯ ডলারে মিলবে ফাইভ সি। মার্কিন চৌহদ্দির বাইরে তা কিনতে লাগবে প্রায় সাড়ে পাঁচশো মার্কিন ডলার। কোথাও কোথাও বা আরও বেশি। আমেরিকায় ফাইভ এসের মূল্য হবে ১৯৯ ডলার থেকে ৩৯৯ ডলারের মধ্যে। আমেরিকার বাইরে কতটা হবে, তার ইয়ত্তা নেই। কারণ, আইফোন ফাইভ এসের বিপুল চাহিদা। এতটাই জনপ্রিয় এই নয়া মডেল, যে ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা ন্যায্য দামে কিনেছেন এটি, তাঁরা অনেকেই তা ২৩০০ থেকে ৩০০০ ডলারে অনলাইন বিক্রি করছেন। অর্থাৎ মোটা লাভ সুনিশ্চিত।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অবশ্য নাক সিঁটকোচ্ছেন। তাঁদের মতে, প্রচারের মাধ্যমে যতটা ‘হাইপ’ তৈরি করেছিলেন অ্যাপলের বর্তমান কর্ণধার টিম কুক, সেই অনুপাতে প্রথম দিনের বিক্রি মোটেও আশাপ্রদ নয়। কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন ফাইভ এসের দাম নিয়েও। যেমন অস্ট্রেলিয়ার অনেক ক্রেতাই আঁতকে উঠেছেন ফাইভ এস এবং ফাইভ সির দাম দেখে। তাঁদের মতে, ফাইভ সি যেখানে আমেরিকায় বিক্রি হচ্ছে ৯৯ ডলারে, সেখানে অস্ট্রেলিয়ার তার দাম ৭৪০ ডলার। ফাইভ এসের দাম ১২০০ ডলার। বেজিংয়ের এক বাসিন্দার আবার দাবি, “বড় বেশি দাম....এগুলো শৌখিন জিনিস।”
ভারতের প্রতিক্রিয়া অবশ্য জানার উপায় নেই। কারণ, ভারতে এই দুই মডেল আসতে এখনও বেশ কিছু দিন। আপাতত ভারতব্যাপী তাই জোরদার অপেক্ষা অ্যাপল দুনিয়ার নয়া জাদুর। |