পুস্তক পরিচয় ১...
‘হিংসে’ই হয়ে উঠতে চায় ‘হিংসা’
ভাতকাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস, অরিন্দম চক্রবর্তী। অনুষ্টুপ, ৪০০.০০
স্ত বেলুনে চড়ে আকাশপথে বেড়াচ্ছিল দুই বন্ধু। হঠাৎ এলোমেলো হাওয়া কোথায় যে এনে ফেলল, ঠাহর হচ্ছিল না। নীচে একজনকে যেতে দেখে তারা ডেকে বলল, ‘ওহে শুনছো, আমরা কোথায় বলতে পারো?’ লোকটি হেঁকে বলল, ‘তোমরা ওই উপরে।’ শুনে এক বেলুনবাজ অন্যকে বলল, ‘এ নির্ঘাৎ অর্থনীতির অধ্যাপক।’
এ নেহাত মোটা দাগের রসিকতা। পোর্ট্রেট নয়, ক্যারিকেচার। আম-আড্ডায় অর্থনীতিবিদ সেই লোক, যে এমন এঁটেসেঁটে কথা বলে যে সন্দেহ হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু সে কথা কোনও কাজেও লাগে না। এমন কৌতুকদৃষ্টিতে অর্থনীতিবিদের চেয়েও মন্দ দশা যাঁর, তিনি দার্শনিক। তাঁর কথা কী কাজে লাগে কে-ই বা ঠাহর করতে পেরেছে। তার ওপর আবার যে কোনও নিশ্চিত কথাকে অনিশ্চিত করে তুলতে তাঁর জুড়ি নেই। আস্ত টেবিলখানা দেখছি, দার্শনিক প্রশ্ন তুলবেন, যখন তুমি ওটাকে দেখোনি, তখনও কি টেবিলটা ছিল? ‘টেবিল আছে’ বলছ, ওর ‘টেবিলত্ব’টা কোথায় আছে বলো দেখি? আর ‘আছে’ মানেটাই বা কী? থাকা, না-থাকার তফাত কোথায়?
শুনলে হাসি পায়, ধৈর্য হারায়। কিন্তু যখন নিজের দুঃখ-ক্রোধ-ঈর্ষা-অনুশোচনার মুখোমুখি হই, তখন টের পাওয়া যায় যে বাঁচার ইচ্ছার মতো, বাঁচার অর্থসন্ধানও সহজাত। যুধিষ্ঠিরের ছাতি যখন ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায়, সামনে পড়ে রয়েছে প্রিয়তম ভাইদের দেহ, তখন ধর্মবক প্রশ্ন করছে, বলো সুখী কে, আশ্চর্য কী, পথ কী, বার্তা কী? কে না জানে, সব চাইতে বিপন্নতার সময়েই এমন সব বেয়াড়া প্রশ্ন হাজির হয়। কখনও প্রিয়-বিচ্ছেদে, কখনও ব্যর্থতার আত্মগ্লানিতে। কখনও বা ভয়ঙ্কর অন্যায় ঘটতে দেখে। ধরুন কামদুনির গণধর্ষণ। ওই মর্মান্তিক নির্যাতন দেখে কেউ গর্জেছিলেন, ওই জন্তুগুলোকে ওই ভাবেই ছিঁড়েখুঁড়ে হত্যা করা হোক। কেউ পরস্পর প্রশ্ন করেছেন, কী অর্থ এই হিংসার? কী চায় ওরা?
অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর ‘প্রসঙ্গ: প্রতিশোধ’ প্রবন্ধে প্রথম দলের সঙ্গে তর্ক জুড়েছেন। প্রতিশোধ এক ধরনের ঋণপরিশোধ, এই ধারণার বিরুদ্ধে বলছেন, ‘ওর যা করা উচিত হয়নি, তা আমার ওর উপর করা উচিত,’ এই বিরোধ প্রতিশোধেই হয়, প্রত্যুপকারে নয়। যে মনে করে, ওকে উচিত শিক্ষা দেব, সে আসলে ‘শিক্ষাদান’ করছে না, করছে ‘শিক্ষাগ্রহণ’— কারণ সে বদ লোকের বদ আচরণের অনুকরণ করছে।
দ্বিতীয় দলকে তিনি উপহার দিয়েছেন একটি নতুন শব্দ। “যে নৈতিক ধর্মবোধ শুধু দণ্ডের ভয়ে অথবা পুরস্কার বা যশের আশায় নয়, ঔচিত্যমাত্র-নির্ভর শুভাশুভবুদ্ধি রূপে পরিণত হয়ে মানুষকে ‘মানবতা’ দেয়, তার মূলে থাকে, মহাভারতের মতে, অনুক্রোশ। প্রতিকারহীন অ-দণ্ডিত অন্যায় অবিচার দেখলে আমাদের ভিতরে যে outrage হয়, তার মধ্যে কিন্তু অনুক্রোশের সঙ্গে এক তীব্র নিঃস্বার্থ আক্রোশের ব্যঞ্জনা আছে। তাই নতুন শব্দ বানিয়ে বললাম ‘উৎক্রোশ’, হয়তো ‘অনুক্রোশ’ও বলা যেত।”
নিঃস্বার্থ আক্রোশ। অনুভবে হয়তো এসেছে, কথাটা এমন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। উৎসে না গেলে এমন করে নতুন শব্দ আহরণ করা কঠিন। এই জন্যই এত দরকার অরিন্দমবাবুকে। দর্শনে তাঁর শিকড়, কিন্তু তাঁর ঝুলিতে তিক্ত-মধুর নানা কাহিনি, আশ্চর্য সব যুক্তি আর অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ। তাঁর বই পড়া খানিকটা হ্যামলিনের বাঁশিওলার সুর শোনার মতো। যদিও জানি, পথের শেষে রয়েছে আত্মসাক্ষাৎকারের মতো ভয়ানক এক পরিণাম, তবু পিছু পিছু যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর কে এমন সহজে ধরিয়ে দেবে, যখনই আমি সন্তানের কাছে আর সব ছেলেমেয়ের হার চাইছি, কিন্তু সন্তানকে হারতে দিতে চাইছি না, তখনই আমি ধর্মচ্যুত হচ্ছি। কারণ ধর্মের লক্ষণই হল, নিজের জন্য যা প্রতিকূল, অন্যের জন্য তা কামনা করো না। নিজের প্রাপ্য ভাগের চাইতে বেশি যে হাতিয়ে নিতে চায়, সে-ই চোর।
শুধু তা-ই নয়, সে নৃশংস। মহাভারতে ভীষ্মকে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করছেন, নৃশংস কে? কুরুক্ষেত্রে দশ দিন ধরে রথী-মহারথীদের কচুকাটা করে ভীষ্ম তখন শুয়ে শরশয্যায়। সেই অবস্থায় উত্তর দিচ্ছেন, উত্তম ভোজ্যর দিকে চেয়ে বসে রয়েছে যারা, তাদের না দিয়ে যে সেই সব খায়, সে-ই নৃশংস। কী কাণ্ড! বুক ফেঁড়ে, মাথা ফাটিয়ে হত্যা, আর না-দিয়ে খাওয়া, দুটো একই রকম দোষের? হ্যাঁ, কারণ দু-ক্ষেত্রেই অন্যকে অস্বীকার হচ্ছে। বাঁচতে না দিয়ে, খেতে না দিয়ে। গাঁধী বলেছিলেন, দারিদ্র হিংস্রতার সব চাইতে খারাপ রূপ। সমতাকে আঘাত করা অপরাধ, অসাম্য তৈরির ব্যবস্থাকে মদত দেওয়াও অপরাধ। ‘সমতা সত্যের প্রথম আকার,’ লিখছেন অরিন্দমবাবু।
এই বইয়ের ১১টি প্রবন্ধে যদি কোনও একটি মূল সুর থাকে, তবে তা সমতা। মানুষে-মানুষে সমতাই সত্য, মঙ্গলময়, এবং তা-ই সুন্দর (সৌন্দর্য শব্দটির সমার্থক ‘সুষমা’, তারই বিপরীত ‘বৈষম্য’)। তাঁর সংক্ষিপ্ত ভূমিকাটিতে নিজের জীবনের যা আভাস দিয়েছেন লেখক তাতে আন্দাজ হয়, সমতা, সামান্যতাকে ‘স্বাভাবিক’ করার সাধনা অতি বাল্যেই তাঁর শুরু হয়েছিল। ‘ক্ষ’ লেখা অভ্যাস করাতে তাঁর গাঁধীবাদী পিতা ছেলেদের ছড়া লেখাতেন,
লক্ষ জনের ক্ষুধার অন্ন
যক্ষের সঞ্চয়
অলক্ষ্যে হয় ক্ষয়।

নিজে সামান্য থেকে সবার সঙ্গে সমান থাকার ইচ্ছেটা অরিন্দমবাবুর মধ্যে এখন প্রকাশ হচ্ছে ‘চমকহীন, চর্বিহীন, চালাকিহীন যুক্তি-গবেষণা-কল্পনা-অনুভূতি চয়নবয়ন করে দর্শনচর্চা’ করার ঝোঁকে। ভাত-কাপড়ের ভাবনা অতি সাধারণ, এমনকী অনিবার্য, তাই সেখান থেকে তাঁর শুরু। ভোজনের এথিক্স এই যে, সমবণ্টন না হলে অন্নভোজন ‘উচিত ও কল্যাণময়’ হয়ে ওঠে না। ‘হিংসে, ঈর্ষা, অসূয়া’ নিবন্ধে দেখাচ্ছেন, অন্যের যা আছে তা আদায় করে ঈর্ষা সমানতা চায়, অসূয়া নিজেরটা আগলে অসাম্য বজায় রাখতে চায়। দুটোতেই অপরাধ-প্রবণতা থাকে, শেষ অবধি ‘হিংসে’ হয়ে উঠতে চায় ‘হিংসা।’
এমন কোনও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়াই দর্শনের কাজ, তা কিন্তু নয়। ‘ডুয়িং ফিলজফি’— দর্শন ‘করা’-ই আসল কাজ। ভাবনা যখন নিজেকেই নিজের বিষয় করে, প্রশ্ন করে ‘কেন এমন মনে হল? ওটা কী করে ধরে নিলাম?’ সেটাই দর্শনচর্চা। তার বিষয় যা ইচ্ছে হতে পারে। ভাত-কাপড় নিয়ে লিখে অরিন্দমবাবু দর্শনকে জলভাত করতে চেয়েছেন। যদিও এমন কিছু প্রশ্ন তিনি আলটপকা ছুঁড়ে দেন, (যেমন, নিষ্কাম প্রেম যদি হতে পারে, তবে নিষ্কাম আস্বাদন নয় কেন?) যাকে জলভাতের চাইতে ‘চুইং গাম’ বললেই ভাল হয়।
এমন একটা বই নিয়ে তর্ক হবে না, তা কি হয়? একটা তর্ক বইয়ের মূল সুর, সাম্যের বিষয়টি নিয়ে। পি সাইনাথ অ্যান্ড কোং-এর প্রতিপাদ্য, ‘দারিদ্রের উৎস মুক্ত-বাজার অর্থনীতিতে, কারণ অসাম্য থেকেই দারিদ্র, আর মুক্ত বাজার অসাম্যকে প্রার্থনীয় মনে করে,’ সেটি লেখক কার্যত বিনা বিচারে গ্রহণ করেছেন। অসাম্য মানেই অন্যায় কি না, সেই তর্কটা পাওয়া গেল না। ন্যায়ের স্বরূপ নিয়ে জন রলস এবং অমর্ত্য সেনের যে তর্কটির সঙ্গে আমরা মোটামুটি রকম পরিচিত, তাতে প্রাপ্যের হেরফের কখন ন্যায্য তা নিয়ে অনেক চিন্তা আছে। ওই প্রশ্নগুলো তেমন করে উঠল না।
অন্য তর্কটা লেখার শৈলী নিয়ে। ভারতের প্রায় কোনও পেশাদার দর্শনবিদ ‘পপুলার ফিলজফি’ লেখার তাগিদ দেখাননি। সে দিক থেকে অরিন্দমবাবুর কাছে বাঙালি পাঠক কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাঁর লেখায় স্বগতোক্তি, পার্শ্বোক্তি বড্ড বেশি। তিনি সুপণ্ডিত, তাঁর মনে যে কোনও কথার অনুসঙ্গে পাঁচটা উদ্ধৃতিযোগ্য কথা ভেসে উঠবে, সেটা প্রত্যাশিত। কিন্তু মনে হলেই লিখতে হবে কেন? ব্র্যাকেট আর ড্যাশের প্রকোপে লেখক-পাঠক সংলাপ ধাক্কা খায়। মনে হয়, নিজে-নিজে কথা বলছেন অরিন্দমবাবু, আমরা আড়ি পাতছি। এই স্বগত-কথনের অভ্যেসটুকু ফিলজফারের ক্যারিকেচারের সঙ্গে মিলে যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.