অনুমান করা চলে, বিশ্বায়িত ভারতীয়রা এই মুহূর্তে নিনা দাভুলুরিকে লইয়া গর্বিত। তিনি প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘মিস অ্যামেরিকা’। তিনি বিজয়িনীর মুকুটে ভূষিত হইবার পরমুহূর্ত হইতে বিবিধ সোশাল মিডিয়ায় যে ভাবে তাঁহার উদ্দেশে বর্ণবিদ্বেষী কটূক্তি ধাবিত হইয়াছে, তাহা অতি দুর্ভাগ্যজনক। ভারতীয় হিসাবে কেহ যদি সেই আক্রমণে অপমানিত বোধ করেন, দোষ দেওয়া কঠিন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের একাংশের বর্ণবিদ্বেষ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগোলিক জ্ঞানের অভাব লইয়া উত্তেজিত মন্তব্য করিবার পূর্বে এক বার নিজেদের দিকে নজর ফেরানো ভাল। নিনা কি ভারতে কোনও সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হইতে পারিতেন? প্রশ্নটি প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, এবং তাহার একটিমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হইল ‘না’। ভারতে গাত্রবর্ণ, বিশেষত নারীর, শ্যাম হইলে তাহার গ্রহণযোগ্যতা শূন্য। তাঁহার শারীরিক সৌন্দর্য অথবা বুদ্ধিবৃত্তি, গাত্রবর্ণের সম্মুখে আর কিছুই দাঁড়াইতে পারে না। ফলে, যে অ-মার্কিনি রূপের কারণে নিনা মার্কিন নাগরিকদের একাংশের নিকট অ-গ্রহণযোগ্য ঠেকিয়াছেন, ঠিক সেই কারণেই তিনি ভারতেও ব্রাত্য থাকিতেন বলিয়াই অনুমান করা চলে। বস্তুত, নিনার ‘মিস অ্যামেরিকা’ হওয়ার মুহূর্তটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট গৌরবের, ভারতের নিকট সমূহ লজ্জার। গৌরব, কারণ সৌন্দর্যের সংকীর্ণ সংজ্ঞা ভাঙিয়া এই বিশ্বায়িত বাস্তবকে স্বীকৃতি দিতে মার্কিন প্রতিযোগিতা আয়োজকদের বাধে নাই— তাঁহারা শ্যামবর্ণা এশীয় নারীকেও নিজেদের স্বাভাবিক জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছেন। লজ্জার, কারণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বাভাবিক গাত্রবর্ণ ভারতে ঘোর বিড়ম্বনার বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। এই বাস্তবের সামনে দাঁড়ানো ভিন্ন উপায়ান্তর নাই।
শ্বেত গাত্রবর্ণ লইয়া ভারতের বিচিত্র আচ্ছন্নতার সব উদাহরণ ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে মিলিবে। আরও মারাত্মক উদাহরণ মিলিবে কয়েক বৎসর পূর্বে হওয়া একটি সমীক্ষায়। সেখানে প্রতি দশ জন ভারতীয় নারীর আট জনই বলিয়াছিলেন, তাঁহারা বিশ্বাস করেন যে গাত্রবর্ণ ফরসা হইলে ভারতীয় সমাজে অধিক গ্রহণযোগ্য হওয়া যায়, এবং কিছু বাড়তি সুবিধাও মেলে। নারীর গৌরবর্ণ লইয়া সমাজের বিকৃত মোহ কোন পর্যায়ে পৌঁছাইলে সিংহভাগ মহিলার বিশ্বাসে এই কথাটি বসিয়া যায়, তাহা ভাবিয়া দেখা প্রয়োজন। এই সমাজে ফরসা হইবার মলমের বিক্রি প্রতি বৎসর প্রায় কুড়ি শতাংশ হারে বাড়িবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী? ভারতীয় সমাজ এখন তুমুল বর্ণবিদ্বেষী, এবং সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যের, এই বিদ্বেষ প্রত্যক্ষ ভাবে আত্মঘাতী। শ্বেত গাত্রবর্ণ লইয়া এই অত্যাসক্তির কারণ কী, তাহার বহুবিধ ব্যাখ্যা রহিয়াছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলিয়াছিলেন, ভারতীয়রা নিজেদের আর্য পরিচয়ে বিশ্বাসী, অথচ আর্যসম গাত্রবর্ণ হইতে বঞ্চিত। সেই খামতি হইতেই এই অতি মোহের জন্ম। ঔপনিবেশিক তত্ত্বের সহিত ফ্রয়েডীয় চিন্তার মিশেলে কেহ বলিতে পারেন, শ্বেতাঙ্গ শাসকদের নিকট অপমানের প্রতিক্রিয়াতেই হয়তো শ্বেত গাত্রবর্ণের নারীকে নিজের অধীন করিবার বাসনাটি জন্মাইয়াছিল। কিন্তু, সেই অতি মোহের কারণ যাহাই হউক না কেন, বলিউড হইতে বিজ্ঞাপনী বাজার, সর্বত্রই শ্বেতাঙ্গিনীর জয়ের ছবি এই একুশ শতকের ভারত সযত্নে আঁকিয়াছে। নন্দিতা দাসের ন্যায় কয়েক জন সেই আধিপত্য ভাঙিতে সচেষ্ট হইয়াছেন বটে, কিন্তু সে প্রতিরোধ এখনও সামান্যই। নিনা দাভুলুরিকে লইয়া গর্বিত হওয়ার মুহূর্তে এই নিজস্ব লজ্জার কথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না। |