আজ শ্রীলঙ্কায় প্রাদেশিক নির্বাচন। মধ্য ও পশ্চিম শ্রীলঙ্কার প্রাদেশিক পরিষদগুলির পাশাপাশি উত্তরের তামিল-প্রধান প্রদেশের নির্বাচনও একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হইতেছে। দুনিয়ার নজর স্বভাবতই শেষোক্ত এই নির্বাচন কাণ্ডে। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং কমনওয়েল্থ-এর প্রতিনিধি এবং পর্যবেক্ষকরাও ঘটনাস্থলে হাজির। নির্বাচন কতটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়, তাহার উপর নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনও নির্ভর করিতেছে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর জাফনা সহ উত্তরের তামিল-প্রধান প্রদেশে ভোটগ্রহণ হইতেছে। মধ্যবর্তী সময় রক্তপাত, গৃহযুদ্ধ, গণহত্যার চরম নৈরাজ্যে কাটিয়াছে। তামিলরাও দীর্ঘ কাল পর স্বাধীন মত দানের সুযোগ পাইয়াছেন, যে-সুযোগ এলটিটিই-ও তাঁহাদের কখনওই দেয় নাই।
লক্ষণীয়, এলটিটিই-র সমর্থক তামিল রাজনীতিকরাই তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়ান্স-এর (টিএনএ) পতাকার নীচে ঐক্যবদ্ধ হইয়া সরকার সমর্থিত ইলম পিপল্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ। ন্যাশনাল অ্যালায়ান্স-এর অধিকাংশ নেতা-কর্মীই এলটিটিই-র প্রাক্তন গেরিলা। শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁহারা সশস্ত্র সংগ্রাম ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসের পথ পরিত্যাগপূর্বক গণতান্ত্রিক রাজনীতির শান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন করার শপথ লইয়াছেন। প্রার্থীদের অনেকেই নিহত কিংবা ‘অদৃশ্য’ বা নিখোঁজ হওয়া গেরিলা নেতার স্ত্রী বা আত্মীয়। তাঁহাদের মনে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি তীব্র ঘৃণাই লালিত হওয়া সম্ভব। নিরীহ, নিরস্ত্র তামিল জনসাধারণের মনেও সরকারের গৃহযুদ্ধ-উত্তর দমননীতি ও বিভেদপন্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ সঞ্চিত হওয়ারই কথা। কিন্তু এলটিটিই-র আড়াই দশক ব্যাপী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসের নির্মম পরিণতি দেখিয়া তাঁহারা বুঝিয়াছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কোনও বিকল্প নাই। তাঁহারা উপলব্ধি করিয়াছেন, প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের পথেই রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ সম্ভব। তাই নির্বাচনকে ঘিরিয়া তামিল জনসাধারণের মধ্যে তৎপরতা শুরু হইয়াছে।
এই প্রাদেশিক পরিষদের গঠন ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হস্তে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও তহবিল অর্পণের বন্দোবস্তটি শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়া চালু হইয়াছিল, ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তি যাহা সম্ভাবিত করে। সেই হিসাবে তামিল-প্রধান প্রদেশগুলিতে তামিল জনপ্রতিনিধিদের হাতে আত্মশাসনের অধিকার ন্যস্ত হওয়ার পিছনে নয়াদিল্লির ভূমিকাটি স্মরণীয়। ন্যাশনাল অ্যালায়ান্সের নির্বাচনী ইস্তাহারে তামিলদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উল্লেখ থাকায় কেহ-কেহ অবশ্য তাহার মধ্যে এলটিটিই-র বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ পাইয়াছিলেন। তাঁহাদের আশ্বস্ত করিয়া অ্যালায়ান্স নেতৃত্ব জানাইয়া দিয়াছেন, ইলম নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ বলিতে শ্রীলঙ্কার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরেই উত্তরের প্রদেশটির প্রাপ্য স্বশাসনকে বুঝানো হইয়াছে। রাজাপক্ষে সরকার মনোনীত প্রার্থীদের পরাস্ত করিয়া অ্যালায়ান্স প্রার্থীই জয়ী হইবেন, এমন অনুমান প্রবল। কিন্তু সংশয় জাগিয়াছে রাজ্যপালের ভূমিকা লইয়া। রাজ্যপাল তো প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষেই নিয়োগ করিবেন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত প্রশাসককে কতটা স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে দিবেন, তাহার উপরই নির্ভর করিবে পরিষদের সাফল্য। শুধু কি নির্বাচিত পরিষদের সাফল্যই? প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে অহোরাত্র যে জাতীয় পুনর্মিলনের সাধনার কথা বলেন, তাহার প্রামাণিকতাও কি এই গণতান্ত্রিক পরীক্ষার উপর নির্ভর করিয়া নাই? বস্তুত, শ্রীলঙ্কায় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি এবং দমনমূলক রাষ্ট্রের দ্বৈরথে গণতন্ত্রের বিপন্নতার দীর্ঘ ইতিহাস রচিত হইয়াছে। সেই ইতিহাসের চাকা ঘুরিবে কি না, তাহাই বড় প্রশ্ন। |