|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
জীবনযাপনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সৌন্দর্যচেতনাও |
সিমায় চলছে ‘আর্ট ইন লাইফ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
এবারেও সিমায় শারদোৎসবের প্রাক্কালে প্রতি বছরের মতো চলছে ‘আর্ট ইন লাইফ ২০১৩’ শীর্ষক প্রদর্শনী। এই উপস্থাপনা কেবল মাত্র ললিত শিল্পের নয়। মানুষের সমগ্র জীবনযাপনের মধ্যে জড়িয়ে থাকে শিল্পপ্রজ্ঞা, প্রচ্ছন্ন সৌন্দর্যচেতনা। তাঁর দৈনন্দিন ব্যবহার্য সমস্ত বস্তুকে সে সুন্দর করে তুলতে চায়। ছন্দিত করতে চায়। এ ভাবেই তাঁর বর্তমানের ভিতর অতীতের দীর্ঘ পরম্পরা প্রতিফলিত হতে থাকে। এই প্রদর্শনী সেই পরম্পরাকেই তুলে ধরে। এই উপস্থাপনা দু’টি ভাগে বিন্যস্ত। একটি পর্যায় চারুকলার অন্তর্গত। সেখানে জোর দেওয়া হয় লৌকিক ও আদিবাসী মানুষের তৈরি শিল্পসম্ভারের উপর। তা আধুনিক নয়, কিন্তু চিরন্তন মানবিক প্রজ্ঞায় ঋদ্ধ। আর একটি পর্যায়ে থাকে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রী শাড়ি, পোশাক, অলঙ্কার, আসবাব, ঘর সাজানোর নানা উপকরণ ইত্যাদি। আমরা অনেক সময় লক্ষই করি না দৈনন্দিনতা কেমন করে নন্দিত হয়ে ওঠে মানুষের চিরন্তন শিল্পপ্রজ্ঞার প্রকাশে। এই প্রদর্শনী সেই দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এ বারে জোর দেওয়া হয়েছে ওড়িশা প্রদেশের চারু ও কারুশিল্পে। ওড়িশার পরম্পরাগত শিল্পের এক নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি আছে, যা অন্যান্য প্রদেশ থেকে আলাদা। ওড়িশার শিল্পে পুরাণকল্পের অতীত কেমন করে স্পন্দিত হয়, তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বিশেষ একটি ছবিতে। প্রথম ছবিটি ওড়িশার প্রবীণ একজন পরম্পরাগত শিল্পীর করা একটি বেশ বড় মাপের পট। শিল্পগুরু অনন্ত মহারাণার ‘দশভুজা দুর্গা’র এই পটটিতে এই প্রদেশের শিল্পপ্রজ্ঞার সমৃদ্ধ প্রকাশ। শঙ্খচূর্ণ, কাজল ও নানাবিধ ভূমিজ বর্ণে আঁকা এই ছবিটিতে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার যে আলেখ্য, তাতে ধরা থাকে ভীষণের এক প্রসন্ন রূপ। দেবী তাঁর হাতের বর্শা আমূল বিঁধিয়ে দিয়েছেন অসুরের বুকে কিন্তু দেবীর চোখে মুখে কোনও প্রতিহিংসা নেই। তাঁর দৃষ্টি প্রসন্ন। সমগ্র পট জুড়ে অন্যান্য যে অবয়ব এবং রেখা ও বর্ণের যে কারুকাজ তাতে আদিমতার তীব্রতা স্নিগ্ধ লাবণ্যে রূপান্তরিত হতে থাকে। |
|
সিমায় আয়োজিত প্রদর্শনীর একটি ছবি
|
এই ছবিটির পরেই পাশের দেয়াল জুড়ে জ্যামিতিক আকারে সাজানো রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট মুখোশ। দক্ষিণ ভারতের এই মুখোশগুলির মধ্যে বিভিন্ন রকম মানবিক অভিব্যক্তি ধরা আছে। আদিমতার তীব্রতা এখানেও রূপান্তরিত হয়েছে লৌকিকের লাবণ্যের দিকে। এই প্রদর্শনীতে মুখোশগুলি আরও বেশি অভিব্যক্তিময় হয়ে ওঠে, দেয়ালে জ্যামিতিক ভাবে সাজানোর গুণে। প্রকৃষ্ট উপস্থাপনা প্রদর্শনীকে যে কত সমৃদ্ধ করতে পারে, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। অনন্ত মহারাণার দুর্গার মুখের সঙ্গে বা ওড়িশা বা বাংলার অন্যান্য মুখোশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের এই মুখোশগুলোর যদি তুলনা করি, তাহলে বোঝা যায় অঞ্চলভেদে প্রকাশভঙ্গিতে কত প্রভেদ ঘটে।
ওড়িশার আরও অনেক কারুকৃতির ভিতর শুকনো ডাব ও নারকেলের খোলার উপর করা মুখোশের আদলের রচনাগুলি সহজ প্রকরণে করা গভীর বোধ প্রকাশের অসামান্য দৃষ্টান্ত।
এই রকম অজস্র কারুকৃতির ভিতর কাঠে তৈরি একটি ছোট বর্ণিল রচনা বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে চিহ্নিত করা যায় এটিকে। দাঁড়িয়ে আছে দশমুণ্ডবিশিষ্ট রাবণ। শরীরের উপর তার নিজস্ব মুখটি কৌতুকদীপ্ত স্মিত হাসিতে উজ্জ্বল। সেই মুখটির দু’পাশে সারিবদ্ধ ভাবে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বর্ণের চারটি করে মুখ। সব মিলে ন’টি মুণ্ড।
আর দশম মুণ্ডটি স্থাপিত রয়েছে মূল প্রধান মস্তকের উপরে। আমরা মুগ্ধ হই দেখে। সেটি একটি ছাগমুণ্ড। কত গভীর প্রজ্ঞা থাকলে যে জীবন নিয়ে এই রকম কৌতুক করা যায়, এই বর্ণিল মূর্তিটি তার অনবদ্য দৃষ্টান্ত।
চারুশিল্পের এই সম্ভারের থেকেও এই প্রদর্শনী বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহারিক সামগ্রীর সম্ভারের জন্য। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতশিল্পের মধ্যে যে শৈল্পিক মনীষার প্রকাশ, সমগ্র বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতেই তা অসামান্য। এই তাঁতশিল্প আজ অনেকটাই সংকটের সম্মুখীন।
বাংলার বালুচরী শাড়ির গৌরবের দিন প্রায় অস্তমিত। তবু ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁত নিয়ে এখনও যে সব গবেষণা হচ্ছে তা কিছুটা আশার সঞ্চার করে। সম্বলপুরের সুরেন্দর মেহের-এর উদ্ভাবিত সম্বলপুরী অলঙ্করণের সঙ্গে দেবনাগরী অক্ষরমালা মিলিয়ে করা একটি শাড়ির ডিজাইন সেই উদ্ভাবনেরই দৃষ্টান্ত। |
|
|
|
|
|