বেড়া তো ভেঙেছেন আগেও বহু বার। কখনও বুকে টেনে নিয়েছেন পঙ্গু ভক্তকে, মিশে গিয়েছেন পুণ্যার্থীদের ভিড়ে, কখনও আবার তরুণ বন্দির পা ধুয়ে দিয়ে চুমু এঁকেছেন পায়ের পাতায়। কিন্তু এ সবই তো সহজ-সরল পোপের সাদামাটা ইচ্ছে। সম্প্রতি এক ইতালীয় পত্রিকার সাক্ষাৎকারে পোপ ফ্রান্সিস যা বলেছেন, তা রোমান ক্যাথলিক জগতের দীর্ঘলালিত বহু ধারণাকেই সমূলে টলিয়ে দিয়েছে। “সমকামী বিয়ে, গর্ভপাত, গর্ভনিরোধকের মতো কিছু বিষয়ে গির্জাগুলো এখনও বেশ গোঁড়া” মন্তব্য স্বয়ং পোপের। কড়া নিয়মের বাঁধনে ঘেরা ভ্যাটিকান নয়, বরং নতুন হাওয়ার সওয়ারি হতে রাজি তিনি। আষ্টেপৃষ্টে কতগুলো নিয়মের জাল বুনে রাখলে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে সব শুদ্ধু। বরং দুইয়ের মিশেলে এক নতুন পথের দিশারী তিনি।
ক্যাথলিক আয়ার্ল্যান্ডে আইনের চোখে নিষিদ্ধ গর্ভপাত। ভারতীয় দন্ত চিকিৎসক সবিতা হালপ্পানাভার শরীরের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছিল গর্ভস্থ ভ্রূণের। সারা দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও মেলেনি গর্ভপাতের অনুমতি। ফলে চিকিৎসকদের চোখের সামনেই মারা যান সবিতা। এই ঘটনার পর দেশ জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন। সবিতার মৃত্যুর পর প্রয়োজনে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করতে অনেকটাই এগিয়েছে আয়ার্ল্যান্ড প্রশাসন। ক্যাথলিক জগতের ধর্মগুরু যখন গর্ভপাতের মতো বিষয়ে মুখ খুলেছেন, সবিতার মতো বহু প্রাণ এ বার বাঁচানো যাবে, আশায় বুক বাঁধছেন অনেকেই।
মোটে ছ’মাস হল ভ্যাটিকানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ফ্রান্সিস। নতুন পোপের জাদু-ছোঁয়ায় বদল আসছে ভ্যাটিকানেও। আর এই পরিবর্তনের আবহেই পোপ ফ্রান্সিসের মুখোমুখি বসেছিলেন ইতালীয় পত্রিকা লা সিভিলতা কাতোলিকা পত্রিকার সম্পাদক আন্তোনিও স্পাদারো। ইতালীয় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ১৬টি দেশের পত্রিকায় ছেপে বেরিয়েছে নতুন পোপের এই সাক্ষাৎকার। মুষ্টিমেয়র নয়, তিনি বিশ্বাস করেন গির্জা হওয়া উচিত সক্কলের আশ্রয় সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস।
অথচ এর ঠিক উল্টো পথেই হেঁটেছিলেন তাঁর পূর্বসুরিরা। ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানে আসার আগে দ্বিতীয় জন পল ও পোপ বেনেডিক্ট মিলে দায়িত্ব সামলেছিলেন মোট ৩৫ বছর। ছোট আর বিশুদ্ধ গির্জার ধারণাই এত দিন ধরে আঁকড়ে ছিলেন তারা। ফলে ভ্যাটিকান থেকে দিনে দিনে দূরত্ব বেড়েছে বহু ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকের। সমকামিতা, গর্ভপাত, বিবাহবিচ্ছেদের মতো কিছু বিষয়ে যাজকদের কড়া অবস্থান দূরে ঠেলে দিয়েছিল এই মানুষগুলোকেও। “অনেক সমকামী আমায় চিঠি লেখেন,” কথায় কথায় জানিয়েছেন নতুন পোপ। “সমাজ তাঁদের গায়ে ক্ষত তৈরি করেছে। তাঁরা অভিমানী। কিন্তু এমনটার তো কোনও দরকার ছিল না” মনে করেন ফ্রান্সিস। উল্টে তাঁর প্রশ্ন, “কোনও সমকামীকে কি ভগবান ভালবাসেন না? ঈশ্বর যদি তাঁদের সঙ্গে থাকেন, তা হলে আমরাই বা থাকব না কেন?” পোপের কথায়, রণাঙ্গনের হাসপাতালের মতো হল গির্জা। গুরুতর জখম সেনাকে যখন সেখানে নিয়ে আসা হয়, তাঁর রক্তচাপ বেশি না কি রক্তে শর্করা, সেই প্রশ্ন তখন অবান্তর। সব চেয়ে আগে দরকার তাঁর শুশ্রূষা। তেমনই, মনে ক্ষত নিয়ে যখন কেউ দু’দণ্ড জিরোতে আসেন গির্জায়, তাঁকে দু’হাত দিয়ে কাছে টেনে নেওয়াই উচিত কাজ।
প্রান্তিক মানুষদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার এই চেষ্টা অবশ্য তাঁর প্রথম নয়। গরিব-দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানো, গির্জার কাজে মহিলাদের আরও বেশি করে সামিল করার জন্য প্রথম দিন থেকেই সওয়াল করেছিলেন ফ্রান্সিস। পোপের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যিনি, সেই স্পাদারোর কথায়, নতুন পোপের জমানায় নিয়ম-নীতি হয়তো সব বদলে যাচ্ছে না। কিন্তু তাঁর একটা স্বপ্ন আছে। তাঁর দেখার ধরনের মধ্যে এমন কিছু আছে যা ভবিষ্যতে আমূল সংস্কারের দরজা খুলে দিতে পারে। সাক্ষাৎকারে যে কেবল সমাজের প্রসঙ্গ এসেছে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও। ভালবাসেন দস্তয়ভস্কির লেখা। মোৎজার্ট, বিঠোফেনের সুরে এখনও মশগুল। আম জনতার ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয় তাঁর জীবন। রক্ত মাংসের আর পাঁচটা মানুষের মতোই ছোটখাটো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে ভরা থাকে তাঁর ঝুলিও। |