শিক্ষকদের বেতন ও পড়ুয়াদের ভাতা আসছে না দীর্ঘদিন। সঙ্কটে পড়েছে রাজ্যের শিশু শ্রমিক স্কুলগুলি। বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা। প্রশাসনের হিসেবে শুধু নদিয়া জেলাতেই নিয়মিত ভাতা না পেয়ে অভাবের তাড়নায় স্কুল ছেড়েছে এক হাজারেরও বেশি শিশু। এই শিশু শ্রমিকদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
কেন এই দশা? রাজ্যের শ্রমসচিব অমল রায়চৌধুরীর দাবি, কেন্দ্র ‘অনিয়মিত’ ভাবে টাকা পাঠানোয় এই বিপত্তি। বুধবার তিনি বলেন, “জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্পের অধীনে ওই সব স্কুলের ছাত্রভাতা ও শিক্ষকদের বেতনের পুরোটাই জোগানোর কথা কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু বহু কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।” তবে, ভাতা না পাওয়ায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, বা ছেলেমেয়েদের স্কুল ছেড়ে দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন তিনি। |
রাজ্যে এ ধরনের বিশেষ স্কুলের সংখ্যা ৯৬০। প্রতিটি স্কুলে নয় থেকে ১৪ বছরের সর্বোচ্চ ৫০ জন ছেলেমেয়ে পড়ে। দু’জন শিক্ষক, দুই শিক্ষাকর্মী থাকেন। শিক্ষকদের বেতন মাসে চার হাজার টাকা, পড়ুয়ারা মাসে ১৫০ টাকা ভাতা পায়। কিন্তু ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকেই অনিয়মিত ভাতা ও বেতন।
অথচ, ২০০৭ সালে চালু হওয়া শ্রমিক স্কুলগুলি অনেক ক্ষেত্রেই পথশিশু, বস্তির শিশু ও শিশু শ্রমিকদের স্কুলে আনতে পেরেছে। অনেকে হাইস্কুলেও পড়ছে। কৃষ্ণনগরের দ্বিজেন্দ্রলাল শিশু শ্রমিক স্কুলের ছাত্র কুরবান শেখ এখন শক্তিনগর হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রণিতে পড়ছে। “টানাটানির সংসার। অনেক বাধা উপেক্ষা করে শ্রমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু অনেক দিন হল বৃত্তির একটি টাকাও পাইনি। বকেয়া টাকাটা পেলে খাতা-পেন কেনার খরচ চালাতে সুবিধে হত,” বলে সে।
বেতন না পেলেও স্রেফ নিজের তাগিদে অনেক শিক্ষক স্কুলে আসছেন। কিন্তু অনেক স্কুলই চলে ভাড়া বাড়িতে। বাড়িওয়ালা ভাড়া মকুব করছেন না। তাই স্কুল আতান্তরে পড়েছে। কিছু স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা। শিশু শ্রমিক প্রকল্পের নদিয়া জেলা আধিকারিক অসীম বালা বলেন, “এক হাজারের উপরে পড়ুয়া স্কুলছুট হয়েছে। শিক্ষকেরা দীর্ঘদিন মাইনে না পেয়ে কাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। স্কুলগুলি সমস্যার পাহাড় নিয়ে কোনও রকমে চলছে। অথচ আমি নিজে বার বার দিল্লিতে দরবার করেও মাইনে ও ভাতা জোগাড় করতে পারিনি।”
নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) উৎপল ভদ্র বলেন, “এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য শ্রম সচিবকে অনুরোধ করেছি। আশা করি, সমস্যা মিটবে।”
মহাকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে, টাকা না মেলার সমস্যার পাশাপাশি শিশু শ্রমিকদের জন্য চিহ্নিত বিশেষ স্কুলগুলির কাজকর্ম পর্যালোচনার জন্য চলতি সপ্তাহে কলকাতায় সমস্ত জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক ও ওই প্রকল্পের জেলা আধিকারিকদের বৈঠক ডাকা হয়েছিল। সেখানে সব জেলাকেই শিশু শ্রমিকদের স্কুল বাবদ কেন্দ্রের কাছে কত পাওনা আছে, তার বিশদ হিসেব তৈরি করে শ্রম দফতরে পাঠাতে বলা হয়েছে। শ্রমসচিব বলেন, “জেলাগুলি হিসেব পাঠানোর পরে বকেয়া টাকা মেটানোর আর্জি জানিয়ে কেন্দ্রের কছে চিঠি পাঠানো হবে।”
শিক্ষার অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পরেও রাজ্যের শিশুশ্রমিকদের এই হাল কেন? সর্বশিক্ষা মিশনের অধিকর্তা ছোটেন লামা বলেন, “ওই আইন কেবল পুরো সময়ের (‘ফর্মাল’) স্কুলকে স্বীকৃতি দেয়। তার মধ্যে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এলেও, শ্রম দফতরের পাঠকেন্দ্রগুলি আসে না।” তাঁর পরামর্শ, ওই শিশুদের মূলস্রোতের স্কুলে ভর্তি হওয়াই উচিত। কিন্তু বয়সের তুলনায় শিক্ষার মান কম থাকায়, শিশুশ্রমিকদের বয়স-অনুসারে শ্রেণিতে ভর্তি করলে স্কুলছুট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, বলছেন শ্রমিক স্কুলের শিক্ষকরা। |
অনিয়মের চিত্র |
নদিয়ায় আসেনি পড়ুয়া-ভাতা, শিক্ষকদের বেতন
২০০৯ সেপ্টেম্বর-২০১০ মার্চ
২০১১ অক্টোবর -২০১৩ মার্চ |
|