কাজ বন্ধ রাখিয়া প্রতিবাদ জানাইবার ভ্রান্তি এই রাজ্যে বহু প্রাচীন। দীর্ঘদিনের সংক্রমণে তাহা কার্যত সর্বব্যাপী হইয়াছে। সর্বগ্রাসীও। হাসপাতালের চিকিৎসকরা অবধি বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদী কর্মবিরতি পালন করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছেন। তবু, স্কুলপড়ুয়াদের শিক্ষা দানের দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, তাঁহারা এই ব্যাধিতে আক্রান্ত না হইলেই মঙ্গল হইত। ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রিশ্চিয়ান স্কুলস আগামী কাল খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত স্কুল এবং কলেজগুলিতে কর্মবিরতির ডাক দিয়াছে। এই আহ্বানে স্বর মিলাইয়াছে অ্যাসোসিয়েশন অব স্কুলস ফর দি আইএসসি, ফলে আইসিএসই বোর্ডের অধীন সমস্ত স্কুল বন্ধ থাকিবে। আহ্বায়কদের মুখপাত্ররা কেহ কেহ জানাইয়াছেন, ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ধ্বংসকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘কড়া বার্তা’ প্রদানের উদ্দেশ্যেই তাঁহারা ধর্মঘট ডাকিতে বাধ্য হইয়াছেন। প্রতিবাদ জানাইবার অনেক উপায় আছে, বিভিন্ন বিষয়ে সেই উপায়গুলি ব্যবহার করা হয়, তাহাতে কাজও হয় মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসার বিরুদ্ধে জনসমাজের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস ইহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় যাঁহাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তাঁহারা নিশ্চয়ই নানা ভাবে প্রতিবাদ জানাইতে পারেন। স্কুলকলেজ বন্ধ রাখিবার ক্ষমতা আছে বলিয়া সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন কেন? এই কর্মবিরতি একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর সংকেত প্রেরণ করিল, এক অতি অসুস্থ নজির সৃষ্টি করিল। বস্তুত, এতদ্দ্বারা প্রতিবাদের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হইল। এখনও কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সময় আছে। ভাবিয়া দেখুন। আত্মসংশোধন করুন। ভুল সংশোধন কিন্তু শিক্ষার একটি বড় অঙ্গ।
প্রতিবাদের উপলক্ষটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াই তাহার পদ্ধতি সম্পর্কে দ্বিগুণ সচেতন ও সযত্ন হওয়া জরুরি ছিল। একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া যে ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আক্রান্ত হইয়াছে, তাহা গোটা সমাজের পক্ষে ভয়াবহ। পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের যথেষ্ট কারণ আছে, পুলিশের কর্তারা যত সাফাই গাহিবারই চেষ্টা করুন, সে সকল অজুহাত কাণ্ডজ্ঞানের ধোপে টিকিবে না। কিন্তু ইহাকে কেবল ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আইসিএসই বোর্ডের অধীন স্কুলের সমস্যা হিসাবে দেখা হইবে কেন? এই প্রতিবাদে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একযোগে শামিল হওয়া বিধেয়। এহ বাহ্য। বিপদ বা উদ্বেগ তো কেবল স্কুলকলেজের নয়, সমগ্র সমাজের। স্কুল পুড়িলে নগর বাঁচে না। দমদমের স্কুলের ঘটনাটি যদি কোনও শিক্ষা দিয়া থাকে, তাহার প্রথম কথা: গোটা সমাজকে, তাহার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে একযোগে সজাগ, সচেতন এবং সচল হইতে হইবে, যাহাতে সমস্যার মূলে পৌঁছানো যায়। প্রশাসনিক তৎপরতা নিশ্চয়ই জরুরি, কিন্তু সামাজিক তৎপরতা কোনও অংশে কম জরুরি নয়। সেই তৎপরতা তখনই যথার্থ একটি উত্তরণের অস্ত্র হিসাবে কার্যকর হইবে, যদি তাহা বিশেষ একটি গোষ্ঠী বা অংশের সীমা অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর সমাজের আয়োজন হইয়া উঠিতে পারে। যে মুহূর্তে একটি বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘আমাদের কর্মবিরতি’ ডাকিয়া প্রতিবাদকে খণ্ডিত করে, সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবাদের প্রেরণা নিস্তেজ হয়, তাহার জোর কমিয়া যায়। যে বিপদ সকলের, তাহাকে একটি অংশের বিপদ বলিয়া ভাবিবার মধ্যে এক ধরনের মৌলিক ভ্রান্তি আছে। সেই ভ্রান্তি সমগ্রের পক্ষেও ক্ষতিকর, শেষ বিচারে ওই অংশের পক্ষেও হিতকর নহে। সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সমাজে এবং বিশেষ ভাবে তাহার শিক্ষাজগতে অনেক ক্লেদ জমিয়াছে, বিভিন্ন ভাবে তাহা অহরহ প্রকট হইতেছে। এই গ্লানি দূর করিবার কাজটি কাহারও একার নহে। |