দলের কর্মীদের উপরে বিলক্ষণ চটে গিয়েছেন বর্ধমানের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী।
কর্মীদের অপরাধ, নিষেধে কান না দিয়ে তাঁরা ওয়ার্ডের ল্যাম্পপোস্টে ল্যাম্পপোস্টে প্রার্থীর ছবি দেওয়া ফ্লেক্স লটকে ভোট-ভিক্ষা করেছেন।
“কী! আমাকেও এখন নিজের ছবি দিয়ে ভোট চাইতে হবে!” বাড়ির বৈঠকখানায় বসে গর্জে ওঠেন তিন পুরুষের আইনজীবী সমীর রায় “সেই ১৯৭৫ থেকে আমি এখানে দাঁড়িয়ে জিতে আসছি! প্রতিটি মানুষ আমায় চেনেন। আমিও প্রত্যেককে চিনি। তাঁদের কাছে এখন আমায় চেনাতে হবে!”
বাস্তবিকই! বামসূর্য যখন মধ্য গগনে, বামবিরোধীদের শক্তি বলতে কিছুই ছিল না, তিনি ছিলেন। এখন যখন পাশা উল্টেছে, তিনি আছেন। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে টানা সাত বার পুরভোটে অপরাজিত। আগে ছিলেন কংগ্রেসে, পরে তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই সেই দলে। ২০০৩-এ যখন বামফ্রন্ট ৩৪-১ আসন নিয়ে বর্ধমান পুরসভা দখল করে, সেই এক মাত্র কাঁটার নামটি ছিল সমীর রায়। গোটা রাজ্যেই এমন রেকর্ড আর কার আছে সন্দেহ।
গত বার ৩২ নম্বর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় সমীরবাবু পাশে ৩১ নম্বরে সরে গিয়েছিলেন। সেখানেও কান ঘেঁষে জিতেছেন। এর পরে বিধানসভা নির্বাচনে ৩২ নম্বরে ১২৮৫ ভোটের লিড পান তৃণমূল প্রার্থী। ওই এলাকায় সমীরবাবুর প্রভাব যে অক্ষুণ্ণ, তা ফের প্রমাণ হয়ে যায়। |
কিন্তু দলের লোকজন নিষেধ না শোনায় গোসা করে সমীরবাবু গত কয়েক দিন প্রচারেই বেরোননি। শেষে কর্মীরা হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ায় ফের বাড়ি-বাড়ি ঘোরা শুরু করেছেন। তবে আগেভাগেই বলে দিয়েছেন, “ওই সব ফ্লেক্স আর পোস্টারের দাম কিন্তু আমি দেব না বাপু! গোটা ভোটপর্ব মেটাতে হাজার টাকার বেশি খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই! ”
আসলে, দু’বার হ্যাট্রিক করে ফেলা প্রবীণ নেতা হয়তো নিজের জয় সম্পর্কে নিশ্চিত। তার কারণও আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস প্রার্থী জ্যোৎস্না গড়াই যেমন নিজেই বলছেন, “আমি ভোটে না দাঁড়ালে তো সমীরবাবুকেই ভোট দিতাম। শুধু দল জোর করায় আমায় দাঁড়াতে হয়েছে।” কিন্তু এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে জনতার প্রত্যাশার পারদও চড়েছে।
প্রচারের সময়ে অনেকেই আগ বাড়িয়ে বলছেন, ‘আপনাকে আমরা কিন্তু শুধু জেতার জন্য ভোট দিচ্ছি না। এ বার পুরপ্রধান হতে হবে!” কলেজ ছাত্রী মৌমিতা দাস সরাসরিই প্রশ্ন করেন, “সমীর জেঠুই পুরপ্রধান হবেন তো?” লজ্জিত মুখে অকৃতদার প্রৌঢ় উত্তর দিচ্ছেন, “সেটা কি আমার হাতে? সেটা তো দল ঠিক করবে।”
সমীরবাবুর ‘পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি’ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ৩৮ বছর ধরে কাউন্সিলর থেকে সমীরবাবু ওয়ার্ডের কতটা কী উন্নয়ন করেছেন, সেই হিসেবের খাতাও খুলে বসছেন কেউ কেউ। বলছেন, সামান্য বৃষ্টিতে এলাকার বস্তিতে তো বটেই, গোটা খোসবাগানেও জল জমে যায়। পানীয় জলেরও সমস্যা রয়েছে অনেক জায়গায়। সমীরবাবুর বক্তব্য, “দীর্ঘদিন আমিই ছিলাম এই শহরে সিপিএমের এক নম্বর শত্রু, শত চেষ্টাতেও যাকে ওরা কাবু করতে পারেনি। তাই আমার ওয়ার্ডকে টাকা না দিয়ে, সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে ওরা আমায় হারানোর চেষ্টা করে গিয়েছে।”
এই সাফাইতেও অবশ্য সবাই চিঁড়ে ভিজছে না। প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে তৃণমূলেরই এক তরুণতর কাউন্সিলর পুরসভাকে চাপ দিয়ে তাঁর ওয়ার্ডের জন্য অনেক কিছু আদায় করে নিয়েছেন। সমীরবাবু তা পারেননি কেন? হাতিপুকুরের বাসিন্দা কৃষ্ণপদ মোড়লের কথায়, “এত দিন হয়তো সিপিএম ওঁকে জব্দ করার জন্য কাজ করতে দেয়নি। এ বার সেই বাধা কাটবে। এ বার উনি বকেয়া কাজগুলো করে দিন।”
হার প্রায় নিশ্চিত জেনেও ৩২ নম্বরের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী মলয় মুখোপাধ্যায় সম্ভবত এই অপ্রাপ্তির কুটোই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। তাঁর দাবি, “আমাদের অনেক পতাকা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবু বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ভাল সাড়া পাচ্ছি। সমীরবাবু বারবার জিতলেও ওয়ার্ডের সমস্যার সুরাহা করেননি।” প্রায় সম্রাট নেপোলিয়নের ঢঙে তাঁর স্বগতোক্তি, “ওঁকে হারানো শক্ত ঠিকই। তবে অসম্ভবও তো কখনও-কখনও সম্ভব হয়!”
আর একটা অঙ্কও হয়তো মনে-মনে কষছেন কেউ-কেউ।
অষ্টম বার রাজ্য সরকার গড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল বামফ্রন্ট। অষ্টম গর্ভের ঠেলায় কংসমামার দশা কে না জানে! আটের গেরো সমীরবাবু কাটাতে পারবেন তো? |