আনন্দplus
যেতে নাহি চাই
কাশ্মীর থেকে ঝুমরিতলাইয়া। কচ্ছ থেকে তিরুপতির মন্দিরের বাইরে লম্বা ভিড়।
আসমুদ্রহিমাচলের কমন জিজ্ঞাস্য, দু’শো টেস্টেই কি শেষ করছেন সচিন তেন্ডুলকর?
তাঁর প্রাক্তন এবং বর্তমান সহ-খেলোয়াড়দের মনেও একই প্রশ্ন। বলা যেতে পারে ভীতি। দেরি করে ফেলবেন না তো তেন্ডুলকর? না কি এখনই দেরি হয়ে গিয়েছে? আরও আগে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল?
ক্রিকেট মহলে হোমরাচোমরা এক ব্যক্তি সে দিন বলছিলেন, “শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে যায় এমন আইকন ভারতবর্ষে এমনিতেই কম। এর পর সচিনের গায়েও যদি কাদা লেগে যায়, তা হলে তো আরওই বিড়ম্বনা।” শুনে মনে পড়ে গেল গত আইপিএল মরসুমে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হোটেল ঘরের এক মুহূর্ত। যেখানে সৌরভকে তাঁর বন্ধু কার্যত অনুনয়-বিনয় করছিলেন, “আর খেলো না প্লিজ। বাংলায় আন্তর্জাতিক আইকন বলতে তুমিই। ফালতু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সেটা বিপন্ন হতে পারে। মশলা ক্রিকেটের জন্য কেন এত বড় ঝুঁকি নেবে?” ঘরে আর যাঁরা ছিলেন তাঁদেরও মনে হচ্ছিল, ঠিক ঠিক ঠিক, সম্মান থাকতে চলে যাওয়াই ভাল।
সৌরভ শুনছিলেন আর মৃদু হাসছিলেন। ওই হাসির সঙ্গে নীরব বক্তব্য ছিল, “আপনার সেন্টিমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার শরীর-আমার চিন্তা, আমিই সব চেয়ে ভাল বুঝি।”
আজও দাদাগিরির প্রত্যাবর্তনের কয়েকটা এপিসোডের মধ্যেই টিআরপি ৯ ছুঁয়ে যাওয়ায় যখন সৌরভকে ঘিরে চ্যানেল এবং ঘনিষ্ঠদের উচ্ছ্বাস, তখন তাঁকে দেখলে মনে হবে সুখকে ছাপিয়ে কোথাও যেন গভীর বিষণ্ণতা। হায় আমার ক্রিকেট-ই শেষ হয়ে গেল। শো-য়ের সাফল্য বা ভাল কমেন্ট্রি করার প্রশংসা দিয়ে আমি কী করব? সৌরভকে আইপিএল-৫ খেলতে দেখে যাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। যাঁরা তাঁর কাছে আশা করেছিলেন আরও রান আর স্ট্রাইক রেটের। যাঁদের মনে হয়েছে, পুণের মাঠে নাইটদের কাছে হেরে এমন বিবর্ণ বিদায় তাঁর প্রাপ্য ছিল না, তাঁরাও মেনে নেন কতগুলো ম্যাজিক মুহূর্ত জীবনের শেষ টুর্নামেন্টে তিনিই তৈরি করে গিয়েছেন। ইডেনে ৫ মে-র রেকর্ড ভিড়। মুম্বইয়ের মাঠে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো অধিনায়কত্ব। পিটারসনকে কোটলায় বোল্ড করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে যাওয়া।
ওই পর্যায়ের সুপার অ্যাচিভারদের আসলে চিন্তার বুনোটটাই আলাদা। মধ্যবিত্ত ভাবনায় যেটা ঝুঁকি আর বিপন্নতা। তাঁদের মস্তিষ্কে সেটাই চ্যালেঞ্জ আর উচ্চতর যুদ্ধ জেতার সম্ভাব্য স্বর্গসুখ।
সচিন যেমন সম্প্রতি মুম্বইয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, “এত কষ্ট করছি, এত ফিজিক্যাল ট্রেনিং নিচ্ছি, সেটা কি এমনি এমনি? সে তো ডেল স্টেইনকে সাউথ আফ্রিকায় খেলার জন্য, না কি?” শ্রোতা হতবাক হয়ে যান। বলছে কী লোকটা! চল্লিশ বছর বয়সে স্লো হয়ে যাওয়া রিফ্লেক্স নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলসদৃশ উইকেটে ডেল স্টেইন খেলবে? তা-ও কি না গত দু’বছর টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি পায়নি! তাঁর এক সহকারী এ সময় থাকতে না পেরে বলেই ফেলেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলে ছেড়ে দিলেই ভাল হয় না? এই পর্যায়ের খ্যাতিতে যদি সামান্যতম আঁচও লাগে...” তিনি শেষ করার আগেই সচিন বলেন, “ক্ষতি হলে হবে তো আমার। আমি বুঝে নেব।” আলোচনা মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্য আপাতত তিনি যে মেজাজ নিয়ে ট্রেনিং করছেন, তা দেখলে কারও মনেই হবে না এটা যে গোধূলিবেলা। বা খেলা ছাড়ার কোনও চিন্তাভাবনা এঁর আছে বলে।
অ্যাসোসিয়েশন কর্তারা যখন তাঁর দু’শোতম ম্যাচ কোথায় হবে, তা নিয়ে সম্ভাব্য লড়াইয়ে দগ্ধ, তখন তিনি, তেন্ডুলকর মনোনিবেশ করছেন ক্রিস গেইলের দেশের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির প্রস্তুতিতে। ভাবনার স্টাইলটাই অন্য সেঞ্চুরির কমে কোনও কিছু নয়! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যদি ভাগ্যক্রমে ধারাবাহিক সিরিজ ব্যর্থতা আসে। যদি গোটা দেশ কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া আওয়াজ তোলে, তোমায় ভালবাসি বলেই বলছি দয়া করে তুমি এ বার যাও। যদি স্ত্রী বা দাদাও বলতে শুরু করেন, এ বার তোমার ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
তা হলে অন্য কথা।
ছবি: উৎপল সরকার
একান্ত তাঁর ওপর থাকলে, দু’শো টেস্টেই শেষ হচ্ছে না তেন্ডুলকরের ক্রিকেট জীবনচরিত। মুম্বই-জোহানেসবার্গ ফ্লাইটে অবশ্যই তাঁকে পাওয়া যাবে। যা হারুণ লগার্ট বা তাঁর দেশের বোর্ড এখনও জানে না। জানলে জয়ধ্বনি দেবে।
টাকা রোজগার কারণ নয়। বাড়তি কিছু রান বাড়িয়ে নেওয়া কারণ নয়। ভাবনার পিছনে কারণ এত বছরের ব্যক্তিগত নেশা। জানি আমি খুব ভাল। জানি আমি অন্যদের চেয়ে ভাল। জানি আমি এখনও অন্যদের চেয়ে ভাল। জানিই যখন সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বেকার ছেড়ে দেব কেন?
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটা প্রথম দিন থেকেই ছিল। চল্লিশ প্লাস বয়সে অবিবেচকের মতো গজায়নি। শিয়ালকোটে ওয়াকার ইউনিসের বল নাকে লাগল ষোলো বছরের কিশোরের। নাক ফেটে গলগল করে রক্ত। উন্মত্ত জনতার চিৎকার, বাচ্চা দুধ পিও। জাভেদ মিঁয়াদাদের টিটকিরি। নন স্ট্রাইকার সিধু আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এলেন, “ছোটু থোড়া রেস্ট লেগা তু?” সচিন ঘাড় নাড়লেন। উঠে দাঁড়িয়ে পরের বলটাই স্কোয়ার ড্রাইভ করলেন ইউনুসকে। বলটা যখন চারের দিকে ছুটে যাচ্ছে, আউটফিল্ডে দাঁড়ানো আব্দুল কাদিরের তখনই মনে হল, রূপকথার নতুন বটগাছ জন্মাতে দেখলেন।
এর পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ফের ভারত-পাকিস্তান। ম্যাঞ্চেস্টারের মাঠে এমনিতেই বেশি সুইং করে, তার পর ওটা আবার ওয়াসিম আক্রমের কাউন্টির মাঠ। কার্গিল যুদ্ধ চলছে। তারই ফাঁকে জাতীয় বিতর্ক সচিনের কত নম্বরে ব্যাট করা উচিত? অসমসাহসী কপিল দেব পর্যন্ত বলে ফেললেন, “চারে যাক। ও শুরুতে আউট হয়ে গেলে, পুরো টিম প্রেসারে পড়ে যাবে।” সেই বক্তব্য সমর্থন করলেন অনেকে। প্রায় কোরাসে দাঁড়িয়ে গেল। ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট ভেবে দেখল, প্রথম ব্যাট করতে হলে ভিজে উইকেটে কিছুতেই সচিন ওপেন নয়। পরে ব্যাট করলে পরিস্থিতি বুঝে দেখা যাবে। পরের দিন বল হাতে ওয়াসিম আক্রম। প্রথম ব্যাট করছে ভারত। তাঁকে ফেস করছেন কে? না, তেন্ডুলকর। চল্লিশের ওপর গুরুত্বপূর্ণ রানও করলেন। ভারত জিতল। ভারতীয় ম্যানেজার বিহ্বল ভাবে পরে ব্যাখ্যাও করলেন, “ওকে কত বুঝিয়ে ছিলাম আক্রম ওদের এক নম্বর বোলার। সঙ্গে শোয়েব আছে। তুমি হলে আমাদের এক নম্বর ব্যাটসম্যান। শুরুতেই হেরে গেলে, আমরা বাড়তি চাপে পড়ে যাব।” তার পর কী হল, সেটাও বললেন ম্যানেজার। সদ্যপিতৃহারা সচিন তখন এমনিতেও খুব চুপচাপ। তারই মধ্যে একটা তীব্র চাউনি হেনেছিলেন, “এটা কেন ভাবছেন না, আমাদের এক নম্বর ওদের এক নম্বরকে হারিয়ে দেবে।”
নিজের মনে তেন্ডুলকর নিজের যে ক্রিকেটীয় ছবি দেখেন, তা নিছকই সর্বোচ্চ রান উৎপাদক যন্ত্র বা সেরা বিনোদনকারীর নয়। নিজেকে দেখেন ভয়ঙ্করতম যুদ্ধের সফলতম নায়ক রূপে। বছরের পর বছর যে চ্যালেঞ্জ আর পুরুষকারের অবিশ্বাস্য সব মহড়া নিয়েছে। তার পর স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়েছে গভীর পুলক নিয়ে।
এত ফিজিক্যাল ট্রেনিং করছি তো চল্লিশে ডেল স্টেইনকে খেলার জন্য, না কি? এই কথাটা যে সচিন তেন্ডুলকর বলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! তাঁর ক্রিকেট জন্ম রূপকথার আবেশে। অন্তেও তো রূপকথার পারফিউম। ষোলোতে ওয়াকার। চল্লিশে একশো ষাট কিলোমিটার গতিতে আসা ডেল স্টেইন।
মধ্যিখানে আবিষ্ট আমরা। স্বপ্ন না সত্যি?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.