|
|
|
|
সিপিএমকে মুকুলের তির, পাল্টা সেলিমের
নিজস্ব সংবাদদাতা |
শনিবার স্কুলের বাইরে জমায়েতের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্দল কাউন্সিলরকে। অভিভাবকেরা ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলনে রাজনীতি ঢুকতে দেবেন না তাঁরা। কিন্তু ২৪ ঘণ্টাও কাটল না, সেই রাজনীতিই ছুঁয়ে ফেলল দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলকে।
এই স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনার জন্য সিপিএমকে দায়ী করলেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। পাল্টা জবাবও দিয়েছে সিপিএম। সম্প্রতি একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব ও ভাঙচুরের জন্য শাসক দলের সমর্থক ও স্থানীয় নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, সিপিএমের ঘাড়ে দোষ চাপানোই তৃণমূলের পরিচিত কায়দা।
স্কুলে তাণ্ডবের ঘটনায় শনিবারই তিন জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তার মধ্যে দু’জন অভিভাবক। এ দিন আরও ১১ জনকে গ্রেফতার করা হল। তার মধ্যেও চার জন অভিভাবক রয়েছেন। |
|
এই কষ্ট ভোলার নয়। তবু মুখে কিছু তুলুন। ঐন্দ্রিলার মাকে
এ ভাবেই খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের শিক্ষিকারা। |
সব মিলিয়ে দু’দিনে ধৃত ১৪ জনের মধ্যে ৬ জনই অভিভাবক! কিন্তু কারও সঙ্গেই রাজনীতির কোনও যোগ পাওয়া যায়নি। শনিবারের জমায়েতে স্কুল খোলার দাবিতে সামিল অভিভাবকেরা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, এই মঞ্চ তাঁরা কোনও রাজনৈতিক নেতাকে ব্যবহার করতে দিতে চান না। সে কারণেই স্থানীয় নির্দল কাউন্সিলরকে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হয়নি। তাই রবিবার তৃণমূল নেতা মুকুল রায় যখন বিষয়টিতে রাজনৈতিক অভিযোগ জুড়ে দিলেন, তখন মৃত ছাত্রীর পরিবার থেকে শুরু করে অভিভাবক বা ভাঙচুরের প্রতিবাদ জানানো সাধারণ মানুষ, বিস্মিত সকলেই।
ছাত্রী-অভিভাবকদের একাংশের বক্তব্য, কোন তিন ছাত্রী ঐন্দ্রিলাকে শৌচাগারে আটকে রেখেছিল, তাদের পুলিশ এখনও চিহ্নিত করতে পারেনি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও হাতে আসেনি। অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করে পুলিশ কিছুটা বেকায়দায়। এই অবস্থায় রাজনীতির রং লাগিয়ে ঘটনা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্কুলের সামনে রবিবার দুপুর থেকে জড়ো হওয়া অভিভাবক ও ছাত্রীদের ওই অংশটি।
বৃহস্পতিবার স্কুলে যখন হাঙ্গামা চলছে, তখনই ঐন্দ্রিলার বাড়িতে যান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। শুক্রবার যান শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। কিন্তু কেউই সেখানে রাজনীতির কথা বলেননি। এমনকী, রবিবার মৃত ছাত্রীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও এমন কিছু বলেননি যাতে ঘটনায় রাজনীতির রং লাগে। কিন্তু তার পরেই ভাঙচুরের দায় সিপিএমের ঘাড়ে চাপান মুকুলবাবু। |
|
ধৃতদের চার জন। লাল শাড়িতে রূপা পাল, আকাশী
নীল শাড়িতে মুমু চন্দ্র। সায়ন ভট্টাচার্য (মাঝে) ও অশোক সাহা। |
কী বলেছেন মুকুল রায়? তিনি বলেন, “ঐন্দ্রিলার মৃত্যু নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তবে দলীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই স্কুলের ঘটনায় মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির যোগ রয়েছে। রাজ্যকে অশান্ত ও কালিমালিপ্ত করতে পরিকল্পিত ভাবে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”
মুকুলবাবুর অভিযোগের পরে চুপ করে থাকেননি সিপিএম নেতৃত্ব। মহম্মদ সেলিম পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেছেন, মুকুল আসলে তাঁর নেত্রীরই কণ্ঠস্বর! সেলিমের পাল্টা বক্তব্য, “ঘটনার দিন স্কুলের সামনে পুলিশ ছিল। তারা ভাঙচুরে তখন বাধা দেয়নি। সিপিএমের লোকজন ভাঙচুর করলে কি পুলিশ সক্রিয় হতো না?” সিপিএমের ঘাড়ে দোষ চাপানোই তৃণমূলের পরিচিত কায়দা এই কথা বলে একই সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “গন্ধ শুঁকেই
ওঁরা বলে দিতে পারেন, কে কোথায় জড়িত!”
বস্তুত, ঘটনার সময়ে বা তার অব্যবহিত পরে হাঙ্গামাকারীদের ধরপাকড় করা নিয়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে এর মধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। অধ্যক্ষাকে হাঙ্গামার রাতেই গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু যাঁরা ভাঙচুর করেছেন, তাঁদের গ্রেফতারি শুরু হতেই দু’দিন লেগে যায়। রবিবার দ্বিতীয় দফায় যাঁদের ধরা হল, তাঁদের ক্ষেত্রেও আবার অভিযোগ উঠল, পুলিশ ভুল লোককে ধরেছে।
এ দিন যে ১১ জনকে ধরেছে পুলিশ, সেই দলে রয়েছেন দুই ভাই সায়ন ও আকাশ ভট্টাচার্য। এলাকার মানুষের অভিযোগ, ঘটনার দিন গোলমালের সময় ওঁরা ভিড়ের মাঝে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু কিছুই করেননি। অথচ পুলিশ অন্যদের সঙ্গে ওই দুই ভাইকেও পাকড়াও করেছে। এলাকার মানুষের অভিযোগ, কাজ দেখাতে এখন এ সব অন্যায় ধরপাকড় করছে পুলিশ। এই গ্রেফতারির প্রতিবাদে সন্ধ্যাতেই স্থানীয় মানুষ মৌনী মিছিল করে দমদম থানায় যান। এই নিয়ে স্মারকলিপিও দেন। পরে দুই ভাইয়ের বাবা নারায়ণ ভট্টাচার্য বলেন, “সায়ন সকালে পাঁচ মিনিট মতো দাঁড়িয়ে গোলমাল দেখেছে। তার পর সে কাজে চলে যায়। কী করে পুলিশ ওদের ভাঙচুর করতে দেখল? ভাঙচুর করার ব্যাপারে ওদের দোষ প্রমাণিত হলে পুলিশকে আসতে হতো না, আমরাই নিজেরা গিয়ে ধরিয়ে দিতাম।”
এ দিন আর যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুই অভিভাবক দম্পতিও রয়েছেন। তাঁরা হলেন রূপা ও বাবলা পাল এবং মুমু ও দেবাশিস চন্দ্র। রূপা ও মুমুদেবীর মেয়েরা ওই স্কুলের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাকি ধৃতেরা হলেন, ঠিকাদার রঞ্জন পাল, কেব্ল কর্মী অশোক সাহা ও মাংস বিক্রেতা তনুময় চক্রবর্তী। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই হাঙ্গামা, মারধর ও সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে ন’জনকে ব্যারাকপুরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক নির্ণয় তামাঙ্গের আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক ধৃতদের তিন দিনের পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে আদালত থেকে বেরিয়ে আসার পথে ধৃতরা জানান, তাঁরা ঘটনার সময় দেখতে গিয়েছিলেন। কিছুই করেননি। দুপুরে গ্রেফতার হওয়া শুভঙ্কর পাল এবং রতন দাসকে আজ, সোমবার আদালতে পেশ করা হবে। তাঁরা দু’জনেই বহিরাগত বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারকেও আজ, সোমবার পেশ করা হবে বারাসত আদালতে। |
আর্চবিশপকে ফোন, দুঃখপ্রকাশ মমতার
নিজস্ব সংবাদদাতা |
ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে আর্চবিশপ অফ ক্যালকাটা টমাস ডি’সুজাকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার দুপুরে টমাস ডি’সুজাকে ফোন করে পুরো বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্যের বাঙালি খ্রিস্টানদের ৭৫ শতাংশই ক্যাথলিক। যাঁদের প্রধান আর্চবিশপ। চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়ার (সিএনআই) অধীনে রয়েছেন আরও ২০ শতাংশ খ্রিস্টান। বাকি ৫ শতাংশে রয়েছেন মেথডিস্ট, ব্যাপ্টিস্ট এবং অন্যেরা। আর্চবিশপ টমাস ডি’সুজাই রাজ্যের অ্যাসোসিয়েশন অফ খ্রিস্টান স্কুলের সভাপতি। যার সম্পাদক হলেন মলয় ডিকোস্টা। মলয়বাবু জানিয়েছেন, অভিভাবকেরা যে ভাবে আইন হাতে তুলে নিয়েছেন, তা দুঃখজনক। সিএনআই-এর প্রধান অশোক বিশ্বাস এখন বিদেশে। তাঁর প্রতিনিধি হয়ে রেভারেন্ড ক্যানিং আজ, সোমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন। সেখানে থাকবেন টমাস ডি’সুজা, মলয় ডিকোস্টা এবং রাজ্যের বিধায়ক শেন কালভার্টও। শেন কালভার্ট এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে পুরো ঘটনার জন্য ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন, তাতে আমরা অভিভূত। তবু সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপরে যে ভাবে হামলা হয়েছে, আমরা তার প্রতিবাদ করব।” দমদম ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ঐন্দ্রিলা দাসের মৃত্যু এবং সেই সম্পর্কিত অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আজ, সোমবার থেকে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন সিএনআই-এর কলকাতা ডায়োসেসের অনারারি সচিব রেভারেন্ড আবীর অধিকারীও। পাশাপাশি, আজ, সোমবারই জেলা পরিদর্শক স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে সরকারি তদন্ত রিপোর্ট জমা করবে বলে জানা গিয়েছে। ঘটনার পরেই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর নির্দেশে জেলা পরিদর্শক স্কুল পরিদর্শন করে এই তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন। আবীর অধিকারী জানিয়েছেন, ছয় সদস্যের ওই কমিটি সোমবার স্কুল পরিদর্শন করবে। তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটি ঐন্দ্রিলার উপর র্যাগিংয়ের ঘটনা থেকে শুরু করে তার মৃত্যুর কারণ এবং সেই সম্পর্কিত যা যা অভিযোগ উঠেছে, সবটাই খতিয়ে দেখবে।” আজ, সোমবারই নজরদারি কমিটির কাজ শুরু করার কথা থাকলেও তা আগামিকাল, মঙ্গলবার কিংবা বুধবার শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন সিএনআই-এর কলকাতা ডায়োসেসের অনারারি সচিব। তদন্ত কমিটির কাজের উপর নজর রাখবে এই কমিটি। এদের তদন্তের উপরই নির্ভর করে রয়েছে স্কুল খোলা বা স্কুলের অধ্যক্ষা হেলেন সরকারের ইস্তাফাপত্র গ্রহণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি। এখনও পর্যন্ত অধ্যক্ষার ইস্তফা গৃহীত হয়নি। এ দিন রাত ৮টা নাগাদ ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের গভর্নিং বডির চার সদস্য স্কুলে ঢুকে ভাঙচুরের পরে তার অবস্থা ঘুরে দেখেন। তবে কী দেখেছেন, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি তাঁরা। |
রবিবার যা হল |
• আর্চ বিশপকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
• ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ ধরল আরও ১১ জনকে
• ঐন্দ্রিলার বাড়িতে সূর্যকান্ত মিশ্র, স্কুলের শিক্ষিকারা
• দমদম থানায় স্মারকলিপি স্থানীয় বাসিন্দাদের |
সোমবার যা হবে |
• হেলেন সরকারকে আদালতে পেশ করা হবে
• স্কুল শিক্ষা দফতরের রিপোর্ট
জমা পড়বে
• চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া স্কুলে গিয়ে তদন্ত করবে |
ওই স্কুলের ঘটনায় মার্ক্সবাদী
কমিউনিস্ট
পার্টির যোগ রয়েছে।
মুকুল রায়,
তৃণমূল নেতা |
গন্ধ শুঁকেই ওঁরা বলে দিতে
পারেন, কে কোথায় জড়িত!
মহম্মদ সেলিম,
সিপিএম নেতা। |
|
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও
সজল চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|