অপুর চিত্রশালা
জানি না, পৃথিবীতে ছ’দশক ধরে আর কোনও সার্থক নায়ক/ অভিনেতার এখনও এত যৌবনদীপ্ত, এত উজ্জ্বল, এত প্রাণবন্ত— সর্বোপরি সৃষ্টিমুখর ব্যক্তিত্ব আছে কি না! আর এটাও বিরলতম যে, তিনি গ্ল্যামার জগতের মধ্যমণি হয়েও সাধারণ মানুষ থেকে নিজেকে কখনও বিচ্ছিন্ন করেননি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ভেসে এলে এক সার্থক বাঙালি আইকন মনে হয়। মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও সংবেদনশীলতার যে পরম্পরা বাঙালির ঐতিহ্যে, তিনি যেন তার সঠিক প্রতিনিধি।
তাঁর আঁকা ছবি আমি আগে কখনও দেখিনি। ছবি আঁকার প্রাথমিক শিক্ষা, যে অর্থে অভিনয় শিক্ষার জন্য প্রথাগত শিক্ষা—তিনি কি নিয়েছিলেন? না, আসলে তার কোনও দরকার হয় না। প্রয়োজন অন্তরের রসদের। সেই রসদকে উজাড় করার প্রক্রিয়া জানার যেমন দরকার একজন কবির। যা আসে আঘাত থেকে। সে আঘাত সুখের হতে পারে, দুঃখেরও। কী ভাবে আসে, তা অন্তর্জগতের ঘটনা। অন্য কেউ জানতে পারে কি? কবি বা শিল্পী শুধু তা অন্যদের কাছে মেলে ধরেন। সেই আঘাতই তিনি মেলে ধরেছেন সিনেমার পরদায়, প্রকাশ্য মঞ্চে, কাব্যপাঠে, আবৃত্তিতে। এ সব ক্ষেত্রেই সহজ বিচরণ তাঁর। এ কাজে তিনি দেশে-বিদেশে সরকারি বেসরকারি, নানা সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।
কিন্তু কোনও কিছুই তাঁর সহজ মনকে বিচলিত করেনি। বৈভব যাঁদের সুখী করে, তা পার্থিব-অপার্থিব যা-ই হোক না কেন, যিনি স্বপ্নে বাসনায় আকাঙ্ক্ষায় তৃপ্ত, তিনি থেমে যান। তাঁর ক্যানভাসে কিছু করার থাকে না। অতৃপ্তিই মানুষকে তাড়িত করে! অন্তরের যন্ত্রণা সৃষ্টিশীল মানুষকে নানা ধারায় ক্লান্তিহীন ভাবে প্রকাশ করার পথ দেখায়। রেখায়, বর্ণে, অভিনয়ে। তাঁর সারা জীবনের অসংখ্য চরিত্রাভিনয়ে প্রেম, ভালবাসা, ঘৃণা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, লোলুপতা, ত্যাগী, ভোগী প্রভৃতি অসংখ্য অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে হয়েছে অভিনয়ে। ছবিতে অভিনয় নেই। সে এক বিমূর্ত অভিব্যক্তি।
এই প্রদর্শনীতে ছোট-বড় আকারে তাঁর অসংখ্য অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। নানা ধরনের চেনা-অচেনা চিরচেনা অবয়ব। এক রঙে আঁকা ছবি। কিছু নানা রঙের। কাটাকুটির প্রেক্ষাপট থেকে কিছু কিছু রঙের ইঙ্গিত। কখনও যেন চেনা অ্যালবাম থেকে স্থায়ী হয় ছবি। কিংবা স্মৃতির শহর, কিংবা অলৌকিক দৃশ্যপট, রহস্যময়ী রহস্যময়তা ধরা পড়ে মনের গহন থেকে বেরিয়ে আসা সাবলীল রেখায়। কোথাও কোথাও তাতে জল-রং দিয়ে এক আলাদা মাত্রা তৈরি হয়েছে। কিছু ছবি মুখোশের মতো।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রদর্শনী ‘ফর্মস উইদিন’য়ের এক ছবি।
নানা জন্তু-জানোয়ারের আকৃতি এসেছে। আমার কাছে জল-রঙের ছবিগুলি যেন তাঁর এক নিজস্ব ধরনের বার্তা দিয়েছে। মনে হয় এ চর্চা হঠাৎ নয়, বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই। রবীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক প্রভাব তাঁর জীবনের নানা শৃঙ্খলায়। এ ক্ষেত্রে তা বিশেষ ভাবে দেখা যায়। শব্দ যেমন চেনা অক্ষরে আশ্রয় নেয়, রেখা-রং এগিয়ে যায় একান্ত নিজের মনের গতিতে। সেখানে চেনা অক্ষরের আইন থাকে না। চিত্রকলা জগতের যাঁরা, তাঁরা সেই রৈখিক ছন্দ কিংবা বর্ণ প্রলেপের ইঙ্গিত থেকে সে ভাষা-চরিত্রকে ধরতে পারেন। যদিও তা সহজসাধ্য নয়। তাঁর অভিব্যক্তি, তাঁর সৃজনশীলতা ধরা পড়ে ছবিতে। বিমূর্ত পটে। প্রকৃতিতে এত প্রাণ, এত গান, এত রূপ— অথচ অহরহ পালটে যাচ্ছে সব। পরতে পরতে জন্ম হচ্ছে ছবি। কেউ কেউ তা দেখতে পান। ধরে ফেলেন। শিশুর মতো সাহসী হন। শিশুর লোকলজ্জা থাকে না। প্রকাশ করতে দ্বিধা থাকে না। পরিণত সৃষ্টি-মনও শিশুর মতো সাহসী হয়, সরল হয়। মাধ্যম অন্তরায় হয় না। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, তাপ-উত্তাপ তাঁকে সাহসী করে।
সৌমিত্রদাকে দেখেছি ষাটের দশকে। রোববারের কলেজ স্ট্রিটে। ট্যামার লেনের মুখে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে আড্ডা দিতে। গগন দত্ত, নির্মাল্য আচার্য আরও কয়েক জন। নিজেই একটা কালো রঙের হিন্দুস্তান গাড়ি চালিয়ে কলেজ রো দিয়ে নবীন কুণ্ডু লেনে নির্মাল্যদাকে নিতে কিংবা ছাড়তে আসতেন। তার পর দেখতাম ইন্দ্রনাথদার (ইন্দ্রনাথ মজুমদার) স্তূপীকৃত পুরনো বইয়ের ঠাসা ঘরে ‘এক্ষণ’য়ের কাজে। মাঝে মাঝে সঙ্গে দীপাবৌদি। তখন তাঁর চামচ সংগ্রহের বাতিক। ইন্দ্রদা জোগান দেন। আমি তখন তরুণ। আমার আনাগোনা সেখানে প্রায় প্রত্যহ। নিউ এম্পায়ারে কমল মজুমদারের পরিচালনায় ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাট্যাভিনয়। অনুষ্ঠান শেষে লবিতে হইচই। কমল মজুমদার, নীরদ মজুমদার, শানুদি, অনুভা গুপ্ত, রবি ঘোষ আর সৌমিত্রদা সপরিবার। হইচই। এ ভাবেই দেখা, চেনা তাঁকে, যা পরদার বাইরের।
চলচ্চিত্রের অভিনেতা হিসেবে তাঁর অবদানে রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ রায় কে কাকে সঞ্চারিত করেছেন, মননে সৃষ্টিপ্রকাশে বলা কঠিন! কে কার পরিপূরক গুলিয়ে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে এটুকু বলতে পারি, তিনি তাঁদের উপলব্ধি করেছেন। অনুভবে, অন্তরে জড়িয়ে প্রকাশ করেছেন যথোপযুক্ত ভাবে। স্বীয় প্রতিভায়, কণ্ঠে, অভিনয়ে, কবিতায়। আমার সেই তারুণ্যের কাল থেকে এত যুগ পেরিয়েও তিনি সমান জনপ্রিয়, আকর্ষণীয়, ব্যস্ততম অভিনেতা। নিষ্ঠায়, পেশাদারিত্বে তাঁর সমকক্ষ প্রায় কেউ নেই। এ প্রদর্শনী থেকে তাঁকে নতুন করে জানলাম। কবি সৌমিত্রের নিজের কথায়,

আশ্বিনে দিন, সোনার আলোয় মোড়া
ছুটছে কোথায় দুরাকাঙ্ক্ষার ঘোড়া
অসীমের তাল বাজে সে অশ্বক্ষুরে
আমারও এ মন যেতে চায় বহু দূরে...


উদ্বোধনের সেই সন্ধ্যায় নবনীতাদি (নবনীতা দেবসেন) পঞ্চাশ দশকের স্বপ্নিল স্মৃতি টেনে প্রায় সমবয়সি সৌমিত্রকে যেন তাঁর যুবতী অভিমানে বললেন, “এত দিন জানাওনি আমায়, তোমার এ আগমনের বার্তা? যখন সময়ের বন্ধুরা একে একে ছেড়ে চলে গেল, তখন তোমার আবির্ভাব হল নতুন করে নব সৃষ্টির উন্মাদনায়!” এটাই তাঁর চিত্রমালা দেখে আমার প্রাপ্তি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.