বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অন্তর্জালে কটূক্তির জেরে
আত্মঘাতী মার্কিন কিশোরী
ছর বারোর ফুটফুটে কিশোরী রেবেকা অ্যান সেডউইক। আর পাঁচটা দিনের মতোই সোমবার সকালে স্কুলের ব্যাগটা পিঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। গোটা দিন আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। অন্য দিন যে সময় স্কুলে বেরোত, মঙ্গলবার সেই সময়ই বাড়ি ফিরল সে। চুল দুলিয়ে, লাফাতে লাফাতে নয়, কাঠের কফিনে বন্দি হয়ে। কোত্থেকে যে কী হয়ে গেল, বুঝতেই পারছেন না রেবেকার মা ট্রিসিয়া নরম্যান।
এই ঘটনার তদন্তে নেমে রেবেকার জামা-কাপড়ের তলায় চাপা দেওয়া মোবাইল ফোনটি হাতে আসে পুলিশ অফিসারদের। আর তার পরই চক্ষু চড়কগাছ তাঁদের। ওইটুকু এক মেয়ের মোবাইলে ডাউনলোড করা গুচ্ছ খানেক ‘অ্যাপস’। কিক মেসেঞ্জার, আস্ক.এফ এম, ভক্সার-এর মতো বেশির ভাগই মূলত চ্যাট মেসেঞ্জার। ছবি-তথ্য সহজেই সব কিছু শেয়ার করা যায় তাতে। পুলিশের দাবি, ইন্টারনেট বেয়েই রেবেকার এই সব অ্যাকাউন্টে দীর্ঘদিন ধরে ভেসে আসত নানা রকম কটূক্তি। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে এই সদ্য কিশোরী।
সোমবার বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর আগে শেষ বারের জন্য কিক মেসেঞ্জারে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছিল রেবেকা। ইউজার নেম পাল্টে রাখে “মৃত মেয়েটা”। আর দু’টো ছোট্ট মেসেজ। দুই প্রিয় বন্ধুকে শেষ বিদায় জানিয়ে। তার পর আর পেছন ফিরে তাকায়নি সে। এক মাইল দূরের এক পরিত্যক্ত এক সিমেন্ট কারখানার চূড়া থেকে ঝাঁপ দেয় রেবেকা। তবে এই তালিকায় সে-ই কিন্তু প্রথম নয়। ভার্চুয়াল জগতের কারিকুরিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে রেবেকার পরিণতি এখন হামেশাই বেছে নিচ্ছে ব্রিটেন, আমেরিকার আজকের প্রজন্ম।
রেবেকার মা, নরম্যানের কথায় সমস্যাটা শুরু হয়েছিল গত বছরই। মেয়ে যখন ক্রিস্টাল লেক মিডল স্কুলে পড়ত, স্কুলের মধ্যেই এক দিন তার উপর চড়াও হয় কিছু ছাত্রী। এই পর্যন্ত না হয় এক রকম ছিল। কিন্তু এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরত মেয়ে। ঘ্যান ঘ্যান করে বলত, “আমার মতো বোকা মেয়ের দ্বারা কিস্যু হবে না।” মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নরম্যান জানতে পারেন বাকি ঘটনাগুলো। স্কুলেরই জনা পনেরো মেয়ে ইন্টারনেটে নানা ভাবে উত্যক্ত করত রেবেকাকে। “তুমি কী কুৎসিত”, “এখনও কেন মরছ না”, এ রকম বীভৎস বার্তায় ভরে গিয়েছিল রেবেকা সেডউইকের ফেসবুক পেজ। এই সব দেখে তড়িঘড়ি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেন মা। কেড়ে নেন মেয়ের ফোনও। এদেরই জ্বালায় গত ডিসেম্বরে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত-পা কাটতে শুরু করে রেবেকা। শেষে নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। বারোর গণ্ডি না পেরোনো মেয়েটাকে বসতে হয় মনোবিদের সামনে। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও তাঁরা জানিয়েছিলেন সব কিছু।
ছবিটা যেন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছিল। মুখ গোমড়া করে থাকা মেয়েটার মুখে ফিরে আসছিল হাসি, উচ্ছ্বলতা। তত দিন ক্রিস্টাল লেক ছেড়ে ল’টন চাইলস মিডল অ্যাকাডেমিতে নাম লিখিয়েছে সে। হাসি-ঠাট্টা-খেলাধুলোর মধ্যে নিজিকে আবার একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছিল মেয়েটা। গানের দলে নামও লিখিয়েছিল, জানিয়েছেন নরম্যান।
রেবেকার ফেসবুক পেজ বন্ধ হলেও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বেয়ে কটূক্তি আসা কিন্তু বন্ধ হয়নি। অভিযোগের তির সেই পুরনো স্কুলের মেয়েগুলোরই দিকে।
ফ্লোরিডার ‘মেন্টাল হেলথ আমেরিকা’ সংস্থার সিইও ডেনিস মারজুলোর কথায়, এই সংস্কৃতি পুরোটাই হালফিলের আমদানি। ছোটরা তাড়িতাড়ি মানিয়ে নিলেও বড়রা কিন্তু এত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারছেন না এর সঙ্গে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে বাবা-মা হয়তো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুললেন। কিন্তু পর দিনই দেখলেন ছেলে বা মেয়ে চলে গিয়েছে টুইটারে। অথবা ইন্সটাগ্রামে। বা হয়তো কিক, ভক্সারে। প্রত্যেক দিনের এই বদলে যাওয়াতেই তাদের আনন্দ। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন বাবা-মায়েরা। মনেবিদদের অনেকেরই মতে, এই ঘটনা এখন আর শুধু ব্রিটেন-আমেরিকাতেই আটকে নেই। ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর সব দেশেই। তিন-চার বছরের কচি হাত বাবা-মা’দের আইফোন, নোটপ্যাড, ট্যাবলেট ঘাঁটছে অভ্যস্ত হাতে।
মনোবিদ তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ছোটদের নানা ভাবে হয়রানি করার ঘটনা আগেও হতো। কিন্তু ইন্টারনেটে নিজের নাম গোপন রেখে অন্যকে উত্যক্ত করা যায় অনায়াসেই। তা ছাড়া, ই-দুনিয়ায় এমন অনেক বন্ধু জুটে যায় যারা কেউ কাউকে দেখেইনি কোনও দিন। ছোটখাটো ঝামেলা থেকে অন্যের পিছনে লাগতে গিয়ে তা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, তার ধারণাও থাকে না এদের।
ছেলে-মেয়েকে এর হাত থেকে বাঁচাতে হলে বন্ধুতার হাত বাড়াতে হবে বাবা-মা’কেই, দাওয়াই তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়ের। জানালেন, “এ রকম ঘটনা কানে এলে বাবা-মা’দের স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, ছেলে-মেয়েকে বকাঝকা করা। তার বদলে তাঁরা যদি একটু ভালবেসে বোঝান, যা-ই হোক সন্তানের পাশে আছেন তাঁরা তা হলে কাজ হবে অনেক বেশি।” উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের উপর নজরও রাখাও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
হাজারো কাজে ব্যস্ত বাবা-মা’র পক্ষে কী ছেলে-মেয়েকে নজরে রাখা এখন আদৌ সম্ভব? সেই অসুবিধে থাকলে বাড়ির কম্পিউটারে এমন সফটওয়্যার লাগান যা নিজে থেকেই আটকে দেবে এই সমস্ত সাইট, জানালেন তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়। তা ছাড়া স্কুলেরও বিশেষ ভূমিকা থাকা দরকার। এ দেশে, ফেসবুক-টুইটারে হাত পাকেনি অনেক বাবা-মায়েরই। এই ফাঁকটুকু পূরণে যদি স্কুল এগিয়ে আসে, তা হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
রেবেকাকে হারিয়ে দুনিয়াটাই যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে মা ট্রিসিয়ার। এখন বুঝছেন, ভবিষ্যতের রেবেকাদের আটকাতে দরকার শুধু একটু ভালবাসার ছোঁয়া।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.