আবর্জনা ও আগাছার জঙ্গল। কাদায় ভর্তি গোটা চত্বর। রোগীর ওয়ার্ডে ঘুরছে শুয়োর, গরু। বিছানার পাশে জমা জলে ঘুরছে সাপ। এই ছবি হাওড়ার একমাত্র কলেরা হাসপাতাল ‘সত্যবালা আইডি’র।
অগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আন্ত্রিকে আক্রান্ত ৪২৯ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যে হাসপাতাল নিজেই রোগে জীর্ণ সেখানে আন্ত্রিকের মতো রোগের যথাযথ চিকিৎসা কতটা সম্ভব?
এ নিয়ে অবশ্য কোনও কথা বলতে রাজি হননি এই হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়: “সমস্যা আছে। যা বলার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই বলবেন।” গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট গোপালকৃষ্ণ ঢালি বলেন, “যে কোনও রোগীকে রাখার জন্য হাসপাতালের উন্নত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ দরকার। না হলে সমস্যা হতে পারে।”
সত্যবালা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পাশে হাওড়া পুরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডে জিটি রোডের উপরে এই হাসপাতাল। ১৯৫১ সালে তিন বিঘা জমির উপর গড়ে ওঠে জেলার কলেরা রোগের চিকিৎসার একমাত্র এই হাসপাতালটি। ১৯৭৬ সালে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতালের দায়িত্ব নেয়।
বাসিন্দারা জানান, কলেরা ও আন্ত্রিকের চিকিৎসায় এই হাসপাতালের গুরুত্ব অপরিসীম। হাওড়া ও বালি পুর এলাকায় বর্ষায় আন্ত্রিক দেখা দিলেই এই হাসপাতালের উপরে চাপ বাড়ে। এমনও হয়, একই বিছানায় একসঙ্গে দু’জন রোগীকে থাকতে হয়। ফি বছর রোগী ভর্তির এই ছবিটা স্থানীয়দের কাছে যেমন খুবই চেনা, তেমনই প্রতি বছর বর্ষার পর থেকেই হাসপাতালের নরক দশার চিত্রটাও সবার কাছে অতি পরিচিত। |
আবর্জনাময়, আগাছায় ভরা সারমেয়দের অবাধ বিচরণস্থলে বেশ কয়েকটি ফলক চোখে পড়ে। সেখানে শিলান্যাস, উদ্বোধনের ফলক যেমন রয়েছে, তেমনই পূর্বতন সাংসদ সিপিএমের স্বদেশ চক্রবর্তী তাঁর তহবিল থেকে হাসপাতাল উন্নয়নে কী করেছেন তা-ও রয়েছে। বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষ তাঁর তহবিল থেকে যে হাসপাতালের দ্বিতল নির্মাণ করেছেন তারও প্রমাণ দিচ্ছে একটি ফলক। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য নতুন ভবনের শিলান্যাস করেছিলেন। অথচ দ্বিতল এখনও চালুই হয়নি। অশোকবাবু বলেন, “হাসপাতালের পরিবেশ খুবই খারাপ। প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বিতল করা হয়েছে। এর অনেক কাজ এখনও বাকি। সেগুলি ধাপে ধাপে করা হবে।”
কিন্তু উন্নয়নের এত ফলকের ছড়াছড়ি থাকলেও উন্নতি কতটা হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে হাসপাতাল চত্বর দেখলেই। জেলার একমাত্র কলেরা হাসপাতালের এই নরকদশা কেন? সদুত্তর নেই কারও কাছেই। প্রত্যেকের কাছেই শুধু মিলেছে প্রতিশ্রুতি। চন্দ্রিমাদেবী বলেন, “রাজ্য সরকার সমস্ত হাসপাতালের উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এখানেও তা করা হবে।” স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। প্রয়োজনীর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
হাসপাতাল সূত্রে খবর, প্রায় ৫২ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন ৩ জন। বাড়তি এক জনকে আন্ত্রিক-পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্য দফতর থেকে পাঠানো হয়েছে। নার্স রয়েছেন ৯ জন। স্থায়ী সুপার না থাকায় জয়সবাল হাসপাতালের সুপারকেই এই হাসপাতালের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কেমন দশা হাসপাতালটির?
হাসপাতালের গোটা চত্বর পাঁচিলে ঘেরা থাকলেও বেশ কিছু জায়গায় তা ভেঙে পড়েছে। মূল গেটের উপরে হাসপাতালের নামাঙ্কিত বোর্ডটি গত বছরের ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। হাসপাতাল চত্বরেই রয়েছে রিকশার গ্যারাজ। ঢোকার মুখেই জমে রয়েছে জল-কাদা। চার দিকে আগাছা ও ঝোপজঙ্গল। ভিতরের পুকুরটির পুরোটাই আগাছায় ভরা। নিকাশি নালাগুলিতে আবর্জনা জমে নোংরা জল উঠে এসেছে রাস্তার উপরে। মেন গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ হাতে রয়েছে সাতটি স্টাফ কোয়ার্টার্স। অধিকাংশ ঘরই ভেঙে পড়েছে। কোনও মতে দু’টি ঘরে থাকেন দু’জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর পরিবার। |
জিটি রোড থেকে হাসপাতাল চত্বর নিচু হওয়ায় জিটি রোডের জমা জলও হাসপাতালে ঢুকে যায়। সম্প্রতি বর্ষাতেও কোমর সমান জল জমেছিল হাসপাতাল চত্বরে। এমনকী, ওয়ার্ডে রোগীর শয্যার নীচেও জল জমে যায় বলে অভিযোগ নার্সদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী বলেন, “জল জমলে সাপের উপদ্রব বাড়ে। রোগীর বিছানার পাশে সাপ, বিছে ঘুরে বেড়ায়।” জেনারেটর না থাকায় রাতে লোডশেডিং হলে মোমবাতিই ভরসা বলে জানান নার্সরা। হাসপাতালে কোনও ল্যাবরেটরি নেই। হাসপাতালের পিছন দিকেই রয়েছে মর্গ ও রান্নাঘর। কিন্তু হাসপাতাল সূত্রে খবর, আজ পর্যন্ত মর্গটি তালাবন্ধই রয়ে গিয়েছে। চার দিকে আগাছার জঙ্গল। বাসিন্দাদের দাবি, রোগীর বাড়ির লোক না আসা পর্যন্ত মৃতদেহ ওয়ার্ডেই ফেলে রাখা হয়। রান্নাঘরের অবস্থাও একই রকম। হাসপাতাল থেকে কোনও রোগীকেই খাবার দেওয়া হয় না।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবাশিস রায় বলেন, “হাসপাতালে যাতে খাবার পরিষেবা চালু করা যায় সে কারণে আবার টেন্ডার ডাকা হবে। হাসপাতালের অবস্থা ভাল করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।” |