খাপ পঞ্চায়েত সর্বশক্তিমান। খাস কলিকাতার ‘সুসভ্য’ নাগরিক পরিসরেও। দমদমের স্কুলে যে ঘটনার প্রতিবাদ জানাইতে অভিভাবকরা একত্র হইয়াছিলেন, সেই ঘটনাটি প্রশ্নাতীত ভাবে দুঃখের। কোনও বিদ্যালয়ে কখনও যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তাহা নিশ্চিত করা এই সমাজের কর্তব্য, প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু, সেই দাবি পেশ করা এক, আর চূড়ান্ত ও ধ্বংসাত্মক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি আর এক। দমদমের ‘অভিভাবক’রা দ্বিতীয় পথ বাছিয়া লইয়াছেন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের দিকে সুনির্দিষ্ট আঙুল তোলা মুশকিল। বিশৃঙ্খলাই এই রাজ্যের অভিজ্ঞান হইয়াছে। রাজ্যব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্রদের বেয়াদবি দেখিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, দমদমে অভিভাবকদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করিল।
এই ঘটনায় লজ্জায় মরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইতে পারে, কিন্তু আশ্চর্য হওয়া মুশকিল। অবাক করিল পুলিশ। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়া এমন তাণ্ডব করা যে বেআইনি, তাহা উল্লেখ করিতে পুলিশ ভুলিয়া গিয়াছিল তর্কের খাতিরে মানিয়া লওয়া যায়। কিন্তু খাপ পঞ্চায়েত যেমন ভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, প্রতিবাদীরা সেই ভঙ্গিতে একের পর এক দাবি পেশ করিয়া গিয়াছেন, এবং পুলিশ নির্বিবাদে মানিয়া লইয়াছে সভ্য সমাজ এই সত্যটি কী ভাবে হজম করিবে? স্কুলের অধ্যক্ষাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করা; পদত্যাগপত্র লেখানো এবং সেই পত্রটি উপস্থিত জনতার পছন্দ হইতেছে কি না, তাহা যাচাই করিয়া দেখা; অধ্যক্ষাকে গ্রেফতার করা এবং তাঁহার বিরুদ্ধে এমন বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ দায়ের করা যেগুলির প্রযোজ্যতা লইয়া প্রশ্ন আছে জনতা যাহা চাহিয়াছে, পুলিশ তাহাই করিয়াছে। গণতন্ত্রে, অতএব নেতাদের নিকট, জনতাই জনার্দন এই কথাটি পুলিশ সম্ভবত কিঞ্চিৎ বেশি পরিমাণে বিশ্বাস করিয়া বসিয়াছে। ফল যাহা হওয়ার, তাহাই হইয়াছে কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাইয়াছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই যাঁহাদের একমাত্র দায়িত্ব, তাঁহারা জনতার আদালতের পেয়াদা হইয়া উঠিলেন। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের উর্দিতে বহুবিধ কালি লাগিয়াছে। কিন্তু ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশকর্মীরা দমদমে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার যে নমুনা পেশ করিলেন, তাহা এই পশ্চিমবঙ্গেও বিরল।
প্রশাসনের কর্তারা বলিতেছেন, ইহা ভিন্ন আর উপায় ছিল না। জনতা যে উন্মত্ত রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহাতে জনতার রায় না মানিলে পরিস্থিতি আরও আয়ত্তের বাহিরে যাইত। প্রশ্ন হইল, পরিস্থিতি লাগামছাড়া হওয়া পর্যন্ত পুলিশ কীসের অপেক্ষায় ছিল? যে সন্ধ্যায় ছাত্রীর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হইয়াছিল, পুলিশ কি তখন বোঝে নাই যে এই খবরে বিক্ষোভ প্রায় অনিবার্য, এবং তাহার কেন্দ্রে স্কুলটিই থাকিবে? এইটুকু পূূর্বানুমানের ক্ষমতা না থাকিলে সরকারি দফতর এবং থানা আলো করিয়া থাকিবার কী প্রয়োজন? সকালেই যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ, বিশেষত মহিলা পুলিশ, মোতায়েন হয় নাই কেন? বিক্ষোভও এক ধাক্কায় তাণ্ডবের চরম স্তরে পৌঁছায় নাই প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় তাহা প্রশ্রয় পাইয়াছে, বাড়িয়াছে। যদি পুলিশ গোড়াতেই সতর্ক হইত, বিক্ষুব্ধদের শান্তিপূর্ণ ভাবে স্কুলের সীমানার বাহিরে রাখা যাইত, তবে জনতার আদালতে প্রধান শিক্ষিকার বিচারের প্রহসন এড়ানো সম্ভব হইত। অভিভাবকদের ক্ষোভ কতখানি সঙ্গত, তাহার বিচার পুলিশের কাজ নহে। সেই ক্ষোভ যাহাতে আইন ও শৃঙ্খলার সীমা লঙ্ঘন না করে, তাহা নিশ্চিত করা পুলিশের কর্তব্য ছিল। পুলিশ নিষ্ক্রিয়, অতএব এই তাণ্ডবে তাহাদের প্রশ্রয় রহিয়াছে সম্ভবত এই বিশ্বাসই তাণ্ডব করিবার সাহস জোগাইয়াছে। পুলিশের চোখের সামনে জনতা নিজের হাতে আইন তুলিয়া লইতেছে এবং শেষ লগ্নে পুলিশ সেই অন্যায়ের নিকট নতজানু হইতেছে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাহাও রহিল না। |