দেবভূমির যাত্রাপথে গুপ্তকাশী থেকে সস্ত্রীক হেলিকপ্টার চেপে কেদারনাথ গিয়েছিলেন। সে জন্য খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার ৪০০ টাকা। চারধামের অন্যতম কেদার দর্শনে পুণ্য অর্জনও হয়েছিল বলেই তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভ্রমণ ভাতা হিসেবে সেই খরচ চেয়েই সমস্যায় পড়েছেন রাজ্য ভূমি ট্রাইব্যুনাল (এলআরটিটি)-এর বিচারপতি প্রভাতকুমার দে। মহাকরণে বারবার তদ্বির করেও কপ্টার-ভাড়ার টাকা পাচ্ছেন না তিনি। অর্থ দফতর জানিয়ে দিয়েছে, বিচারপতিদের ভ্রমণ-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে কপ্টারের ভাড়া দেওয়ার কথা বলা নেই। ফলে সরকার এই খরচ দিতে অপারগ।
অর্থ দফতরের এ হেন অবস্থানে বেজায় চটেছেন বিচারপতি প্রভাতকুমার দে। রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর কাছে বেশ কয়েক জন অফিসার সম্পর্কে অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি। ভূমিসচিবকেও ঘটনাটি জানিয়ে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিচারপতি দে সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, “অর্থ দফতরের কয়েক জন অফিসার যে ভাবে পরের পর বিল আটকে দিচ্ছেন, তাতে ট্রাইব্যুনালের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হচ্ছে। সরকার সংশ্লিষ্ট অফিসারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিক, যাতে ট্রাইব্যুনাল তার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে। অর্থ দফতরের নেতিবাচক মনোভাবে যেন এখানকার কাজ ব্যাহত না হয়।”
অর্থ দফতরের এক কর্তা অবশ্য বলেন, “সরকারি নিয়মে বাঁধা অর্থ দফতরের আধিকারিকরা। ফলে বিচারপতি চাইলেই তাঁরা বিল মঞ্জুর করে দিতে পারেন না। বিচারপতিদের প্রাপ্য তালিকায় কপ্টার চড়ে তীর্থ ভ্রমণের বিল মেটানোর কথা বলা নেই। অর্থ যতই সামান্য হোক না কেন, তাই বিলটি কয়েক বার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ওই কর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট বিচারপতি সরকারি নির্দেশনামায় যদি দেখিয়ে দিতে পারেন যে, তিনি কপ্টার চড়ার খরচ পাবেন, তা হলে, সরকার তা দিতে বাধ্য। কিন্তু এলআরটিটি এখনও তেমন কিছু দেখাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি দে বলেন,“হেলিকপ্টার ভাড়া কেন পাওয়া যাবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারকেই যা বলার বলেছি। এ নিয়ে বাইরে কিছু বলব না।” কিন্তু বিচারপতির ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সরকার যদি বিমান ভাড়া দিতে পারে, তা হলে হেলিকপ্টার ভাড়া দেবে না কেন? বিচারপতি তো খরচ ও সময় বাঁচাতেই গুপ্তকাশী থেকে কেদার পর্যন্ত কপ্টারে চেপে গিয়েছিলেন। অর্থ দফতরের পাশাপাশি রাজ্যের ভূমিসচিব অমরেন্দ্রকুমার সিংহকেও এমন অবিচার নিয়ে সরব হতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু ভূমি দফতরও এ নিয়ে উদ্যোগী না হওয়ায় বিচারপতি মর্মাহত। ভূমি দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “এ নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই, যা করার ‘পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস’ই করবে।” এমন পরিস্থিতিতে কপ্টার ভাড়া না নেওয়ার কথাও বিচারপতি ভাবছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানানো হয়েছে।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ভ্রমণ-ভাতায় কপ্টার ভাড়া না পেয়ে বিচারপতি দে গত ১৭ জুলাই অর্থসচিবকে একটি কড়া চিঠি (মেমো নম্বর: ১৪/পিকেডি/এলআরটিটি) লেখেন। তাতে ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি বিল না মেটানোর জন্য অর্থ দফতরের কয়েক জন অফিসার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়। এমন চিঠি নজিরবিহীন বলে মনে করছেন মহাকরণের কর্তারা।
অর্থ দফতরের অসহযোগিতার কথা জানাতে গিয়ে বিচারপতি লিখেছেন, ‘ট্রাইব্যুনালে যোগ দেওয়ার পর আমি ভ্রমণ-ভাতা নিইনি। ২০১৩-১৪ সালে প্রথম ভ্রমণ-ভাতা নিয়ে বেড়াতে যাই। কলকাতা থেকে নয়াদিল্লি হয়ে গঙ্গোত্রী পৌঁছোই। গঙ্গোত্রী থেকে গুপ্তকাশী যাই মোটরে। তার পর গুপ্তকাশী থেকে কেদার যাওয়ার জন্য আমি ও আমার স্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়েছিলাম। যার ভাড়া ছিল মাত্র ১৫ হাজার ৪০০ টাকা। বারবার বলা সত্ত্বেও অর্থ দফতর এই বিল মেটাচ্ছে না।’ তবে শুধু তাঁর ভ্রমণ-ভাতা আটকে দেওয়াই নয়, দফতরের কিছু অফিসার কী ভাবে ট্রাইব্যুনালের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করছেন, তার উদাহরণও তিনি দিয়েছেন সরকারকে লেখা চিঠিতে।
বিচারপতি লিখেছেন, গাড়ির জ্বালানি বাবদ সরকার মাসে ১২০ লিটার তেল অথবা ১২০০ কিলোমিটার যাতায়াত দু’টির মধ্যে যেটি কম হয়, তা দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ট্রাইব্যুনালের এক জুডিশিয়াল মেম্বার বা বিচারবিভাগীয় সদস্যের গাড়ির বিল ফিরিয়ে দেয় অর্থ দফতর। ওই বিল নিয়ে কিছু অযৌক্তিক ব্যাখ্যা তলব করা হয়। ১২ জুলাই এখানকার এক কর্মীর ১৬১৪ টাকা মেডিক্যাল বিল নিয়েও আপত্তি জানায় তারা। ট্রাইব্যুনালের এক প্রশাসনিক সদস্য মে মাসের টেলিফোন বিল বাবদ ১৪০০ টাকা দাবি করেছিলেন। এ বছর ২১ জুন সেই বিলও ফেরত পাঠিয়ে দেয় অর্থ দফতর।
এর পরই বিচারপতি দে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন, অর্থ দফতরের কাজ কী এলআরটিটি-র কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটানো? সামান্য টাকার জন্য যে ভাবে বারবার বিল ফেরত পাঠানো হচ্ছে, তাতে এখানকার কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে। যদিও অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “নিয়ম মেনে খরচ হলে পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসারেরা বিল ফেরত পাঠান না। টাকার অঙ্ক বড় কথা নয়, তা ঠিক ভাবে খরচ হয়েছে কি না, সেটা দেখাই অর্থ দফতরের কাজ। কোনও অফিসের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এমন করা হয় না।”
সব মিলিয়ে তাই, কেদারযাত্রায় পুণ্য লাভ করলেও বিচারপতি দে-র কাছে তার কপ্টারভ্রমণের বিল মঞ্জুর করানোই এখন কঠিন কাজ। |