পর্যটন প্রসারে কোপ পড়ছে পরিবেশের উপরেই।
রাজ্য পর্যটন নিগমের নতুন বিজ্ঞাপন, ঝড়খালির ট্যুরিস্ট হাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল দেশের বেশ কয়েকটি পরিবেশ প্রেমী সংগঠন।
এ বার, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক। প্রশ্ন তুলেছে অসামরিক বিমান মন্ত্রকও।
বিদ্যাধরী, হেড়োভাঙা আর মাতলা, তিন নদীর ঘেরাটোপে প্রান্তিক জনপদ ঝড়খালি। সুন্দরবনের গহিন এই এলাকাটিকে দেশের পর্যটন মানচিত্রে ঠাঁই দিতে সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ‘ট্যুরিস্ট হাব’ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। তিন তারা হোটেল, বিলাসবহুল ক্রুজ, এমনকী আকাশ পথে সুন্দরবন ভ্রমণেরও সুযোগ থাকছে সেখানে।
ঝড়খালির সেই চোখ ধাঁধানো পর্যটন-পরিকল্পনা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এবং পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুলি।
রাজ্যের বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনও বলছেন, “বন্যপ্রাণের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে ট্যুরিস্ট হাব গড়া সমীচীন নয়। তবে, সমীক্ষার পরেই বোঝা যাবে ঠিক কী করতে চায় পর্যটন দফতর। ছাড়পত্রের প্রশ্ন তার পরে।”
হায়দরাবাদ এবং চেন্নাইয়ের পরে গুজরাত থেকে রাজ্যে পর্যটক টানতে দিন কয়েক আগে আমদাবাদে দু’দিনের পর্যটন শিবির করেছিল নিগম। সহযোগী ছিল বণিকসভা ফিকি। সেখানে নিগমের সব চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ছিল, শিলিগুড়ির অদূরে গজলডোবা আর সুন্দরবনের ঝড়খালির ট্যুরিস্ট হাব। পর্যটন নিগমের অধিকর্তা ভীষ্মদেব দাশগুপ্ত জানিয়েছিলেন, এই দু’টি ট্যুরিস্ট হাব-ই এখন তাঁদের পাখির চোখ। পিপিপি মডেল অনুসরণ করে ওই দুই প্রকল্পে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা লগ্নির আশা করছেন তাঁরা। মাস তিনেকের মধ্যেই প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপরেখাও তৈরি হয়ে যাবে বলে দাবি করেছিলেন ওই নিগমকর্তা। |
কিন্তু, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির স্থান-কাল ঘোষণার পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
হেড়োভাঙা নদীর কোলে বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল ছেঁটে এবং সাড়ে পনেরো বিঘা জলাজমি বুজিয়ে প্রকল্পটি হলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্রে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বিশ্ব বন্যপ্রাণ তহবিল বা ডব্লুডব্লুএফ। এ বার, তা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিল বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’ বা এনটিসিএ।
পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার ‘হবু’ সমস্যাগুলিকে অবশ্য গ্রাহ্যের মধ্যে আনছেন না পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। তাঁর যুক্তি, “ঝড়খালির ট্যুরিস্ট হাব নিয়ে সমস্যার কিছু নেই। যা হবে পরিবেশবিদদের পরামর্শ নিয়েই হবে।” তিনি জানান, তিন-তারা বিলাসবহুল হোটেলের পাশাপাশি আম-পর্যটকের কাছে সুন্দরবনের দরজা খুলে দিতে কম দামি আবাসও থাকবে ট্যুরিস্ট হাবে। অল্প খরচের লঞ্চ-সাফারির সঙ্গে থাকছে আকাশ পথে সুন্দরবন ভ্রমণের সুযোগও।
ঝড়খালির আকাশে নিয়মিত কপ্টার উড়বে শুনে অসামরিক বিমানমন্ত্রকের প্রশ্ন, ঝড়খালির আকাশে কপ্টার উড়লে বাংলাদেশ সীমান্ত লঙ্ঘন হবে না তো? কারণ, সীমান্তবর্তী জেলায় ৫ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই উড়ান সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। এটাই সরকারি বিধি। ঝড়খালির অদূরে বাংলাদেশ সীমান্ত। নিতান্ত জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া ওই সীমানা লঙ্ঘন করতে হলে প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকারের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) অনুমতি। ডিরেক্টর জোরেল অফ সিভিল এভিয়েশনের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “ঝড়খালির কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই বাংলাদেশের জল-সীমা। ওখানে হেলিকপ্টার উড়লে সীমানা লঙ্ঘনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আকাশ পথে প্রমোদ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এটিসি ওই সীমানা লঙ্ঘন অনুমোদন করবে না।”
জঙ্গলের সামান্য উপর দিয়ে হেলিকপ্টার ওড়ার প্রশ্নে আপত্তি রয়েছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকেরও। বছর কয়েক আগে, উত্তরাখণ্ডের করবেট জাতীয় উদ্যানের উপরে হেলিকপ্টারে চড়ে চক্কর দেওয়ায় এক জার্মান দম্পতির হাজতবাস হয়েছিল। পরিবেশ মন্ত্রক যে ঝড়খালির আকাশেও সেই ছাড়পত্র দেবে না তা বলাই বাহুল্য।
ট্যুরিস্ট হাবের প্রশ্নে ঝড়খালির আশপাশের গ্রামের মানুষ আশার আলো দেখলেও তাঁরা জানেন, পরিবেশ ক্ষুণ্ণ করে কিছু করা মানেই অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুযোর্গকেই ডেকে আনা। ঝড়খালি পঞ্চায়েত প্রধান দিলীপ মণ্ডল বলেন, “ট্যুরিস্ট হাব হলে কর্মসংস্থানের দরজা হয়তো খুলবে, কিন্তু জল-জঙ্গলকে আঘাত করে কিছু করা মানে আরও একটা আয়লার পথ প্রশস্ত করা।”
সাধারণ মানুষের এই যুক্তির সমর্থন মিলছে পরিবেশবিদদের কথাতেও। এনটিসিএ-র এক কর্তা বলেন, “সুন্দরবনের সঙ্গে দেশের অন্য জঙ্গলের তুলনা চলে না। কারণ, ম্যানগ্রোভের ওই জঙ্গলে বড় মাপের ট্যুরিস্ট হাব হওয়ার অর্থই বনের পরিবেশ ক্ষুণ্ণ করা। দেশের অন্যান্য ব্যাঘ্র প্রকল্পের গা ঘেঁষে বা ‘বাফার’ এলাকায়, ট্যুরিস্ট হাব করা যায়। সুন্দরবনে তা করা মানেই জঙ্গলের নির্বিঘ্নতায় হস্তক্ষেপ।”
ডব্লুডব্লুএফ-এর সুন্দরবনের দায়িত্বে রয়েছেন অনুরাগ দণ্ড। তাঁর প্রশ্ন, “সদ্য বাঘসুমারিতে দেখা গিয়েছে হেড়োভাঙা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা যথেষ্ট। ওই এলাকায় বড় মাপের ট্যুরিস্ট হাব মানেই পশুদের একান্ত জীবনযাপন বিঘ্নিত হওয়া।” তিনি জানান, সুন্দরবনের বাঘ কখনওই পর্যটকের অবিরত ‘অনুপ্রবেশ’ পছন্দ করে না। বাঘের সংখ্যা যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সুন্দরবনে তাই সহজে বাঘের দেখা মেলে না। অনুরাগবাবু বলেন, “পর্যটকদের মন পেতে খাঁড়িতে ঘন ঘন লঞ্চ ঢুকলে বা সুন্দরবনের আকাশে কপ্টার উড়লে বাঘ তো এলাকা ছেড়ে চলে যাবেই।”
অদূরেই বাংলাদেশ, ব্যাঘ্রকুল যদি সে পথেই পা বাড়ায়! |