গত এক দশক তিনিই ছিলেন বর্ধমান শহরের মুকুটহীন রাজা।
যদিও তাঁর দল রাজারাজড়ায় বিশ্বাস করে না। কুর্সির কথাও বলে না, অন্তত মুখে। বরং জনগণের জন্য দলের দেওয়া দায়িত্বের কথাই আওড়ায়। সেই দায়িত্বের নাম যখন ‘পুরপ্রধান’, রাতারাতি মাঠ ছেড়ে নেতা পালানই বা কী করে?
আইনূল হকও পালাননি। তবে মাথা বাঁচাতে নিজের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সংখ্যালঘু এবং নিম্নবিত্ত অধ্যুষিত ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। যে কথা উঠলেই তৃণমূল নেতারা ভুরু নাচিয়ে বলছেন, “আরে, দশ বছর যা করেছে, ওখানে দাঁড়ালে গো-হারা হারত।” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গলা ঝেড়ে বলছেন, “এটা তো দলের সিদ্ধান্ত। দল বলেছে শহরের মাঝখানে কোনও একটা ওয়ার্ডে দাঁড়াতে। তাই আমি এখানে।”
বিধানসভা ভোটের পর থেকেই যে বর্ধমানে বামেদের বিধি বাম, সে কথা আর কে না জানে! ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের পোস্টার-ব্যানার-ফ্লেক্স দেখে মনে হচ্ছে, লড়াইটা আসলে তৃণমূলের অরূপ দাসের সঙ্গে কংগ্রেসের তোবরেজ খানের। অলি-গলিতে একদা নির্দল কিন্তু একটানা ভোটে জেতা প্রয়াত সুনীল দাসের ছোট ভাই অরূপের নির্বাচনী অফিস। যখন-তখন মাইক হাঁকিয়ে রিকশা বলে যাচ্ছে তোবরেজের নামও। সেখানে আইনূল সাহেবের নির্বাচনী অফিস কই? ফ্লেক্স-ব্যানার-লালঝান্ডাই বা কোথায়? সিপিএম বলছে, ও সব লাগিয়ে লাভ নেই। ওরা (পড়ুন, তৃণমূল) তো সব খুলে দেবে। তার চেয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি-বাড়ি ঘুরে যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছেন। ভোট যদি ঠিক মতো হয়, উনি বিশাল মার্জিনে জিতবেন। |
শুনে বিরোধীরা হাসছে। বলছে, এখনও পর্যন্ত মোটে তিন দিন প্রচারে এসেছেন ‘বহিরাগত’ সিপিএম নেতা। তা-ও প্রথম দিন সামনে-পিছনে পুলিশ নিয়ে মিছিল করতে হয়েছিল। এলাকার তৃণমূল নেতাদের দাবি, “ওঁর সঙ্গে তো বহিরাগতেরাই আসছে প্রচারে। প্রচুর সামাজবিরোধীও থাকছে।” বিদায়ী রাজার জবাব, “সমাজবিরোধীরা কাদের সঙ্গে রয়েছে, মানুষ দেখতেই পাচ্ছেন। আমার সঙ্গে প্রচারে যাচ্ছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, ভদ্রজনেরা।” তাঁর বিরুদ্ধে গত এক দশকে অনেক নয়ছয়ের অভিযোগই তুলে এসেছে বিরোধীরা। যদিও তার সপক্ষে নথিপত্র কেউ হাজির করেনি। তৃণমূলের আইনজীবী প্রার্থী অরূপ দাস এখন প্রচারে নেমে বলছেন, “এলাকায় বস্তি রয়েছে প্রায় চারটি। সেগুলিতে পানীয় জল নেই, প্রায় রোজ জল নিয়ে মারপিট হয়। নিকাশি নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে। আগের মহিলা সিপিএম কাউন্সিলার ভোটে জেতার পরে কোনও দিন আসেননি। আইনূল সাহেবেরা মানুষকে দেখেননি। তাই মানুষও ওঁদের দেখবেন না।”
গত বিধানসভায় নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে তৃণমূল ২১৪৬ এবং সিপিএম ১৮২৫ ভোট পেয়েছিল। সেই হিসেব ধরলে সিপিএমের স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। তারা বরং অন্য হিসেব কষছে। জেলা নেতাদের আশা, নতুন সরকারের দু’বছরের শাসনে নানা ঘটনায় হারানো সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক অনেকটাই ফিরতে পারে। দ্বিতীয়ত, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বস্তি এলাকায় বেশ কিছু পুরকর্মী রয়েছেন। দুঃসময়ে তাঁরা বিদায়ী প্রধানের পাশেই থাকবেন। আপাতত লিফলেট দিয়ে ভোটারদের ‘বিবেক’ জাগ্রত করার শেষ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বক্তব্য: এ বারের ভোট শুধু তৃণমূল বনাম বামফ্রন্টের লড়াই নয়। শহরবাসীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষার পরিবেশ, নারীদের সম্ভ্রম এবং গণতন্ত্র-সম্প্রীতির ঐতিহ্য অটুট থাকবে কি না, তারই মীমাংসা করবে এ বারের ‘নির্বাচনী সংগ্রাম’।
সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক। কিন্তু নয়া এই রঙ্গমঞ্চে বর্ধমানের এত দিনের রাজা স্রেফ বিবেকের ভূমিকাতেই থেকে যান কি না, জানা যাবে পর্দা উঠলেই। |