বিদ্যুতের মতো বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের লাইন। জল খরচ মাপতে বাড়িতে বাড়িতে মিটার। আর মিটারের রিডিং অনুযায়ী বিদ্যুতের মতোই বিল। পশ্চিমবঙ্গের কিছু পুরসভায় গৃহস্থের থেকে জলকর আদায়ের এমন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ বার শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা বলবৎ হতে চলেছে গ্রামাঞ্চলেও। যার সূচনা হওয়ার কথা পুরুলিয়া জেলা দিয়ে।
সরকারি সূত্রের খবর: জাপানি ঋণে পুরুলিয়ার দশটি ব্লকে পাইপলাইনে জল সরবরাহের প্রকল্প নির্মাণে হাত পড়বে আগামী বছরের গোড়ায়। সেটি রূপায়িত হলে সাড়ে ১২ লক্ষ মানুষ বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ পাবেন। এবং আর্থিক ভাবে সমর্থ উপভোক্তাদের থেকে জলকর আদায় করেই প্রকল্পটির পরিচালন খরচ তোলা হবে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছেন বলে মহাকরণ-সূত্রে জানা গিয়েছে। শিল্প, কৃষির পরে সামাজিক পরিষেবা ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন সংস্কার কর্মসূচিকে এক কথায় ‘বৈপ্লবিক’ হিসেবে অভিহিত করছে প্রশাসনিক মহল।
মহাকরণের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০০৩-এ কলকাতা পুর-এলাকায় জলকর আদায়ের প্রশ্নে তদানীন্তন তৃণমূল পুরবোর্ডের মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতবিরোধ হয়েছিল। মেয়র চাইলেও আমনাগরিকের ঘাড়ে বাড়তি করের বোঝা চাপানোয় আপত্তি তুলেছিলেন নেত্রী। শেষমেশ মামুলি গৃহস্থকে বাদ দিয়ে শুধু বৃহৎ বাণিজ্যিক গ্রাহক ও আবাসনের মতো বিভিন্ন বড় গ্রাহককে জলকরের আওতায় আনা হয়েছে হালের তৃণমূল বোর্ডের আমলে। তখনকার বিরোধী নেত্রী এখন প্রশাসক। পুরুলিয়ার গ্রামে জলকর আদায়ে ছাড়পত্র দিলেও তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ: দারিদ্রসীমার নীচের (বিপিএল) পরিবারের কাছ থেকে পানীয় জল বাবদ কোনও কর নেওয়া যাবে না।
সরকারি সূত্রের খবর, মমতার এই ‘মডেল’ অর্থ দফতর অনুমোদন করেছে। পাশাপাশি, গরিবকে ছাড় দিয়ে সম্পন্ন (এপিএল), বাণিজ্যিক ও বড় গ্রাহকদের থেকে জলকর নিলে ঋণদাতা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-রও আপত্তি নেই বলে প্রশাসনের দাবি। |
প্রকল্প পুরুলিয়া |
আওতায় |
২০টি ব্লকের ১০টি
(রঘুনাথপুর-১, কাশীপুর, পারা, পুঞ্চা, পুরুলিয়া-১ ও
২, মানবাজার-১, বলরামপুর, বড়াবাজার, নিতুরিয়া) |
তৈরি হবে
৪৫টি ছোট জল প্লান্ট |
জল মিলবে
দিনে দু’বার, ৭০ লিটার* |
আনুমানিক ব্যয়
১২৭৬ কোটি** |
কাজ শুরু
মার্চ ২০১৪ |
জাইকা দেবে
১০০০ কোটি**
(বাকি কেন্দ্র-রাজ্য আধাআধি) |
শেষ হবে
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ |
* সংযোগপিছু। ** অঙ্ক টাকায় |
|
এ দিকে পুরুলিয়ার প্রকল্পটি রূপায়ণের দায়িত্ব বর্তেছে যাদের উপরে, ঘটনাচক্রে রাজ্যের সেই জনস্বাস্থ্য কারিগরি (পিএইচই) দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এখন সুব্রতবাবু। যিনি বলছেন, “জলকর আদায় নিয়ে ভারত সরকার জাপানকে আগেই কথা দিয়েছিল। আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। জাইকা-র টাকা আনা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়!” কলকাতার প্রাক্তন মেয়র এ-ও জানিয়েছেন, তৃণমূল পরিচালিত কলকাতা পুরসভার জলকর মডেলই পুরুলিয়ায় কার্যকর হবে। এবং গ্রামবাসীরাই সমিতি বা অন্য কোনও ভাবে প্রকল্পটি চালাবেন। “এমন রুখা-শুখা জায়গায় পানীয় জলের ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল। প্রকল্প গড়ে সরকার তা গ্রামের মানুষের হাতে তুলে দেবে। কর আদায় নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত ওঁরাই নেবেন।” মন্তব্য সুব্রতবাবুর। তাঁর আশা, বিশুদ্ধ পানীয় জল পেলে গ্রামবাসীরা সামান্য টাকা দিতে পিছপা হবেন না।
পিএইচই-র তথ্য বলছে, বাম আমলে রাজ্যের কয়েকটি শহরে টাকার বিনিময়ে জল সরবরাহ প্রকল্প চালু হয়েছিল। এখনও কিছু পুর-এলাকায় নাগরিকদের আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল কিনতে হয়। তা ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগনা বা মুর্শিদাবাদে এমন কয়েকটি আর্সেনিক প্রকল্প চলছে, যেখানে গ্রামবাসীরা সমিতি গড়ে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। পরিশুদ্ধ জল নেওয়ার জন্য তাঁদের টাকা দিয়ে কার্ড করাতে হচ্ছে।
সেই ধাঁচেই পুরুলিয়ায় ‘জাইকা মডেল’ কার্যকর করার উদ্যোগ। তবে এখানে পাইপলাইনে জল যাবে বাড়িতে বাড়িতে, রাজ্যে যা প্রথম। পিএইচই-সূত্রের খবর, প্রকল্পটি গড়তে জাইকা নামমাত্র সুদে ঋণ দিচ্ছে। জাপানি সংস্থাটির বক্তব্য: রুক্ষ ওই জেলায় জলের মূল উৎস ভূগর্ভ। কিন্তু ফি গ্রীষ্মে জলস্তর নেমে যাওয়ায় প্রবল সঙ্কট দেখা দেয়। সঙ্গে রয়েছে ফ্লুওরাইড-দূষণ। এই জোড়া সমস্যার মোকাবিলায় তারা ওখানে জল-প্রকল্প গড়তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। কাজ শেষ হওয়ার পরে ৩০ বছর (প্রয়োজনে ৪০ বছর) ধরে সরকার তা শোধ করবে। এই ঋণেরই শর্ত, জলকর বসাতে হবে। সেই সঙ্গে জলচুরি রুখতে হবে কড়া হাতে। জাপানিদের যুক্তি, সরকারের কাজ প্রকল্প গড়ে দেওয়া। তা চালু রাখার দায়িত্ব গ্রামবাসীর। গ্রাহকদের থেকে কর আদায় করে তাদেরই সেটা করতে হবে।
সেই মতো দশ ব্লকের প্রস্তাবিত ৪৫টি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য ৪৫টি জল নিয়ন্ত্রণ সমিতি গড়া হচ্ছে, যাদের হাতে থাকবে কর আদায় ও প্রকল্প পরিচালনার ক্ষমতা। পিএইচই-র এক কর্তার কথায়, “পানীয় জল তৈরি করে জলাধারে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কাজ। জলাধার থেকে বাড়ি-বাড়ি জল পৌঁছানোটা সমিতির দায়িত্ব। যেমন সাব-স্টেশন থেকে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের লাইন দেওয়ার ভার বণ্টন কোম্পানির।” সংযোগের খরচ থেকে শুরু করে মাসিক জলের বিল মেটাতে হবে গ্রাহককেই।
সরকার কেন জাপানি শর্ত মেনে নিল? পিএইচই-র মুখ্য-বাস্তুকার (পশ্চিমাঞ্চল) ধ্রুব চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা, “এ নিয়ে দিল্লির সঙ্গে টোকিও-র চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। একটা রাজ্য তা বদলে দিতে পারে না। বিপিএল-দের বাদ রেখে জলকর বসাতে অর্থ দফতরও আপত্তি করেনি।” সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই উদ্যোগটিতে এগোনো হয়েছে বলে ধ্রুববাবুর দাবি। জলকরের হার নিয়েও সরকারের অন্দরে প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তা হয়েছে। কী রকম?
দফতরের খবর, বাণিজ্যিক বা বড় গ্রাহকদের এখন দৈনিক কিলোলিটারপিছু ১৪ টাকা হারে কর দিতে হয়। কোথাও কোথাও কাগজে-কলমে নিয়ম আছে, রাস্তার ধারে পাইপলাইন থেকে জল নিলে দিনে ১ টাকা হিসেবে মাসে ৩০ টাকা দিতে হবে। পুরুলিয়ার গ্রামেও সংযোগপিছু মাসে অন্তত ৩০ টাকা লাগবে। “এর উপরেও কিছু লাগতে পারে। সমিতির হাতে তার ক্ষমতা দেওয়া থাকছে। তারা দেড়-দু’হাজার টাকা সিকিওরিটি ডিপোজিট নিয়ে বাড়ি বাড়ি লাইন দেবে। বাড়িতে মিটার বসাবে। সেই মতো বিলও আদায় করবে।” বলেন এক সরকারি কর্তা।
আপাতত জল-সংস্কারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে পুরুলিয়া। |