জলখাবারে রুটি চেয়েছিলেন স্বামী। রুটি না থাকায় পান্তাভাত বেড়ে দেন বছর সাতাশের তরুণী। অভিযোগ, তা নিয়ে অশান্তির জেরেই বঁটির বাঁট আর শাবল দিয়ে পিটিয়ে ওই বধূকে খুন করেছেন তাঁর স্বামী। তারপর গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে চিলেকোঠায়। গোটা ঘটনায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইন্ধন জুগিয়েছে বলেও মৃতার বাপের বাড়ির লোকজনের অভিযোগ। স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির সকলেই ঘটনার পর থেকে পলাতক।
|
রিনা বেগম।
—নিজস্ব চিত্র |
সোমবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে মুর্শিদাবাদের সালারে কাগ্রাম পঞ্চায়েতের বহড়া গ্রামে। নিহত রিনা বেগম (২৭) এ বারই মহিলা সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেসের টিকিটে জিতে পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছিলেন। সোমবার ছিল প্রথম বোর্ড মিটিংয়ের দিন। সে দিনই ঘটল এই ঘটনা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণকে যেখানে মেয়েদের ক্ষমতায়নের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেখানে রিনার মৃত্যু প্রশ্ন তুলে দিল রাজনীতি কি আদৌ গ্রামের বধূ-কন্যাদের নির্যাতন রুখতে পারবে? নাকি ভোটের লড়াইয়ে জিতেও হেরে যেতে হবে জীবনের লড়াইয়ে? মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় গ্রামের একটা মেয়ের নিজের শ্বশুরবাড়িতে থেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করাটা ভীষণ কঠিন। কারণ সেখানে সে আগে ঘরের বউ, পরে পঞ্চায়েত সদস্য। বাইরের জগতের কাজ সামলাতে গিয়ে মেয়েদের বরাবরই দাম দিতে হয়। এই মেয়েটিকে প্রাণ দিয়ে দাম চোকাতে হল।”
কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর মনে করেন, এই ঘটনায় পৌরুষে আঘাতের চিরায়ত ব্যাধিই ফের প্রকাশ্যে এসেছে। মৌসমের কথায়, “স্ত্রী বেশি সফল বলে হয়তো ওই মহিলার স্বামীর আগে থেকেই রাগ ছিল। রুটি দিতে না পারার অজুহাতে সেই রাগের বদলা নিয়েছেন হয়তো!” শুধু সংরক্ষণ দিয়ে এই সমস্যার প্রতিকার করা যাবে না বলেও মৌসমের অভিমত। তাঁর মতে, “সমাজের মানসিকতা না বদলালে কোনও লাভ নেই।”
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এন সি আর বি) ২০১২-র রিপোর্ট অনুযায়ী, সামগ্রিক ভাবে নারী নির্যাতনে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশের মধ্যে সবার উপরে। শুধু ধর্ষণ নয়, পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যে মেয়েদের উপর আক্রমণ আসছে মূলত ঘরের ভিতর থেকে, যাকে আমরা বলি ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’ বা গার্হস্থ্য হিংসা। জনসংখ্যা পিছু ঘরোয়া নির্যাতনের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশে দ্বিতীয়। এ রাজ্যে ৪৫.১৩ শতাংশ মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। সেখানে রাজনীতির আঙিনায় থাকা আর না থাকা মেয়েদের মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই। রিনার মৃত্যুও সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। ত্রি-স্তর মিলিয়ে এ বার পঞ্চায়েতে আসন ছিল ৫৮,৮৬৫টি। তার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ ৪৩২ জন অবশ্যই মহিলা সদস্য।
বছর এগারো আগে বিয়ে হয়েছিল রিনার। স্বামী ফিরোজ শেখ পেশায় দর্জি। চাষবাসও করেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ঘটনার সময় তারা ছিল স্কুলে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, সোমবার বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ছেলেমেয়েরা চিলেকোঠার ঘরে মায়ের দেহ ঝুলতে দেখে। তারাই মামাবাড়িতে গিয়ে সব জানায়। রিনার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, দুই ননদ ও দেওরের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন রিনার ভাই মকবুল হোসেন। মকবুল বলেন, “ঘটনার দিন আমি দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ওরা দিদির সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।” এই ঘটনায় এখনও কেউ গ্রেফতার হয়নি। অভিযুক্তরা সকলেই পলাতক। মুর্শিদাবাদের জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “খুনের মামলা রুজু হয়েছে। তদন্ত চলছে।” পড়শিদের একটা বড় অংশের দাবি, ঠান্ডা স্বভাবের রিনার উপরে শ্বশুরবাড়িতে হামেশাই নির্যাতন হত। মারধর ছিল রোজকার ব্যাপার। রিনার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, বিয়ের পর প্রথম দু’বছর বাপের বাড়ির যোগাযোগ থাকলেও পরে শ্বশুরবাড়ির চাপে তা বন্ধ হয়ে যায়। পড়শিদের বাড়িতেও যেতে দেওয়া হত না রিনাকে। কংগ্রেসের অঞ্চল সভাপতি বাবু দত্তের কথায়, “রিনা ভাল মেয়ে ছিল। গ্রামবাসীরাও ওকে খুব ভালবাসত। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।” পিতৃহারা রিনার বাপের বাড়িতে ভাই ছাড়া আছেন মা মেহেরুন বেওয়া। যিনি বারবার বলে চলেছেন, “মেয়েকে যারা খুন করল, তাদের শাস্তি না হলে শান্তি পাব না।” |